প্রথম পাতা

বিশ্ব বাণিজ্যে নয়া মেরুকরণ

প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১২ নভেম্বর ২০১৫

সরকার মাহফুজ

ঝুড়িতে পণ্য থাকলে তা বিক্রির জন্য ক্রেতার অভাব হয় না বাংলাদেশের। উৎপাদন খরচ অন্যদের চেয়ে কম হওয়া ও ধনী দেশগুলোয় শুল্কমুক্ত সুবিধা এ দেশের রফতানিকারকদের অন্য দেশের প্রতিযোগীদের চেয়ে এগিয়ে রাখে। কিন্তু সুবিধা বেশিদিন থাকছে না। ইউরোপিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের দুই প্রতিযোগী ভারত ও ভিয়েতনাম আলাদাভাবে দুটি মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করতে চাইছে। ওই দুটি চুক্তি হলে বাংলাদেশের রফতানি খাত চরম সংকটে পড়ার আশঙ্কা আছে। ইতোমধ্যে ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক, চামড়া, জুতা ও ওষুধের প্রতিযোগী হয়ে উঠেছে ভিয়েতনাম।   
যখন ইউরোপের সঙ্গে বিভিন্ন দেশ চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছে, বাংলাদেশ কেবল তা চেয়ে চেয়ে দেখছে। বৈশ্বিক বাণিজ্যের নয়া মেরুকরণে বাংলাদেশের কোনো ভূমিকা নেই। এমনকি বড় কোনো বাজারের সঙ্গে এখন পর্যন্ত কোনো দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির প্রস্তাবই দিতে পারেনি বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের রফতানি খাতের বেশি আয় হয় এমন তিনটি বাজার হলো ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা। এসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশে মুক্তবাণিজ্যের কোনো চুক্তির প্রস্তাব নেই। ওইসব দেশ যেসব বড় চুক্তিতে অংশ নিচ্ছে সেখানেও বাংলাদেশ নেই। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ৪০টির মতো দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ওইসব দেশের মধ্যে ভারত, চীন ও তুরস্ক বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য বাজার। কিন্তু তুরস্ক বাংলাদেশের পোশাকে ১৭ শতাংশ ‘সেইফ গার্ড ডিউটি’ আরোপ করে রেখেছে। বাংলাদেশের পাটে অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপের উদ্যোগ নিচ্ছে ভারত।
রাশিয়া, আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান ও শ্রীলংকাসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তির আলোচনা করছে বাংলাদেশ। এসব দেশে বাংলাদেশের রফতানি খুবই নগণ্য। সব মিলিয়ে আগামীতে বাংলাদেশের রফতানি খাত কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় বাজার হারানোর ভয়
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ১২টি দেশের ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তিটি স্বাক্ষরের বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত। এ চুক্তির অধীন দেশগুলো বিশ্ব বাণিজ্যের ৪০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। অবশ্য বাংলাদেশের চিন্তার কারণ আপাতত যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বাজার নিয়ে এবং চিন্তা উদ্রেককারী দেশ ভিয়েতনাম।
যুক্তরাষ্ট্র একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের প্রধান বাজার। সেদেশে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় না বাংলাদেশ। এখনো ভিয়েতনাম-কেও শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করতে হয়। কিন্তু টিপিপির পর পর ভিয়েতনাম রফতানি করবে শূন্য শুল্কে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ধরার জন্য বিভিন্ন দেশের কোম্পানিগুলো ভিয়েতনামে বিনিয়োগ করছে। প্রায় ২০ হাজার কোম্পানি ভিয়েতনামে বিনিয়োগ করেছে টিপিপির আশায়। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ ৫২৯ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছে। এটি মোট পোশাক রফতানি আয়ের ২১ শতাংশ। টিপিপি কার্যকর হলে বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলারের পোশাকের বাজার হাতছাড়া হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।
ভিয়েতনামের কারণে কানাডার বাজারেও বড় ধরনের প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে বাংলাদেশের পোশাক। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের পর কানাডাই বাংলাদেশি পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে কানাডায় বাংলাদেশ প্রায় ৯৩ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছে। এটি মোট পোশাক রফতানির ৩.৬৪ শতাংশ। নতুন খবর হলো ভারত টিপিপিতে যোগ দিতে চাচ্ছে। দেশটি ওই চুক্তিতে যোগ দিলে আরো বেকায়দায় পড়বে বাংলাদেশ।
ইউরোপের বাজার নিয়ে শঙ্কা তৈরি করছে দুই চুক্তি
২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের ৩১ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয়ের ১৭ বিলিয়ন ডলার এসেছে ইউরোপ থেকে। সেখানে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত আরো বছর দশেক থাকাটা প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু বাংলাদেশের ঘুম কেড়ে নিচ্ছে ভারত ও ভিয়েতনাম। ইউরোপের সঙ্গে ভিয়েতনাম ও ভারতের মুক্তবাণিজ্য চুক্তি হলে বাংলাদেশের পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যসহ মাঝারি আকারের রফতানি খাতগুলোও বিপাকে পড়তে পারে। এদিকে পাকিস্তানের কাছ থেকে হোম টেক্সটাইল খাতে ধাক্কা খেয়েছে বাংলাদেশ। পাকিস্তান গত বছর জানুয়ারি থেকে ইউরোপে জিএসপি প্লাস সুবিধা পাচ্ছে। এর মানে হলো আগের চেয়ে অনেক কম শুল্কে পাকিস্তানি পণ্য ইউরোপে প্রবেশ করতে পারছে। এতে বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশের হোম টেক্সটাইল রফতানি।
আরসিইপিতেও নেই বাংলাদেশ
রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি) নিয়ে আলোচনায় আছে আসিয়ানভুক্ত ১০টি ও এশিয়ার ৬টি দেশ। দেশগুলো হলো ব্রুনাই, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া, চীন, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও নিউজিল্যান্ড। নেই বাংলাদেশ। এই ১৬ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের মাঝারি ও সম্ভাবনাময় বাজার হলো জাপান, চীন, কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত। চীন ও জাপানে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ যথাক্রমে ৭৯ কোটি ও ৯২ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করে। বাংলাদেশের চামড়া ও পাদুকা শিল্প অনেকাংশে জাপানের ওপর নির্ভরশীল। অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ গত বছর ৫৩ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছে।
আরসিইপি স্বাক্ষরিত হলে জাপান, চীন, অস্ট্রেলিয়া ও কোরিয়ার বাজারে প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে বাংলাদেশ। এসব দেশে রফতানি বাড়বে ভারত, ভিয়েতনাম, মিয়ানমারসহ প্রতিযোগী দেশগুলোর। পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশ।
টিআইএসএ
যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউসহ ২৪টি দেশের মধ্যে সেবা বাণিজ্যের চুক্তি ট্রেড ইন সার্ভিসেস অ্যাগ্রিমেন্ট (টিআইএসএ) স্বাক্ষর নিয়ে ব্যাপক গোপনীয়তায় কাজ চলছে। ফলে এর প্রভাব কী হবে তা বোঝা কঠিন। এ চুক্তিতে আছে পাকিস্তান। অবশ্য বাংলাদেশের চিন্তার বিশেষ কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশের সেবা বাণিজ্যে বড় কোন ভূমিকায় নেই।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh