
বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি গুঞ্জরিত বিষয় তিস্তার পানির হিস্যা প্রসঙ্গ। তবে আরেকটি শুকনো মৌসুম সামনে রেখেও বাংলাদেশে কেউ জানে না তিস্তা পানি চুক্তি কবে হবে। গণমাধ্যমে মাঝে মধ্যেই খবর বের হয়, ‘শিগগিরই চুক্তি হচ্ছে।’ সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বরে ঢাকায় এক আলোচনা সভায় ভারতীয় হাই কমিশনার পঙ্কজ শরণ বলেন, ‘পর্দার আড়ালে তিস্তার প্রবাহ নিয়ে চুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টা চলছে।’
ভারতের নতুন কৌশল
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং ২০১৫ সালের জুনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকালেও তিস্তা চুক্তি না হওয়ার জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দায়ী করে। তিস্তা চুক্তি নিয়ে মমতার একগুঁয়েমিটি অগ্রাহ্য করার হুমকি দিলেও এখনো সে দেশের নীতি-নির্ধারকদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নতুন সমীক্ষা শেষেই কেবল ভারত সিদ্ধান্ত নেবে তিস্তার প্রবাহে কোনো ‘বাড়তি পানি’ আছে কি না এবং বাংলাদেশকে ‘আদৌ কোনো পানি দেয়া যায় কি না।’
ভারতের এমন নতুন কৌশলে বাংলাদেশের পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় কিছুটা বিস্মিত। সম্ভাব্য চুক্তির খসড়া বিনিময়ের পর এখন নতুন সমীক্ষার কথা বলা হচ্ছে। এটি পুরনো অবস্থান থেকে সরে যাওয়ার কৌশল বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের শঙ্কা, তথাকথিত সমীক্ষার আগে তিস্তার পানি নিয়ে হয়তো আর চুক্তি হবে না। তেমনি সমীক্ষার পরও ভারত এমন কোনো প্রস্তাব দেবে যা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চুক্তি স্বাক্ষর দুরূহ করে তুলবে।
আলোচনার টেবিলে ‘পানি’ নেই
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অমীমাংসিত সমস্যার তালিকা কমছে না। বিশেষ করে বাণিজ্যিক ভারসাম্যহীনতা ও তিস্তা নদীর পানি বণ্টন সমস্যার সমাধান করতে না পেরে শেখ হাসিনা ও মনমোহন সিংয়ের সরকার প্রকৃতই কূটনীতিক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিল। মোদি সরকারও একই নীতি অনুসরণ করছে। বাংলাদেশের ব্যর্থতার পাল্লা এক্ষেত্রে বেশি ভারী। কারণ তিস্তায় পানি পাওয়া যাবেÑ এই আশায় বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতকে করিডর সুবিধাসহ তাদের চাহিদামতো অন্যসব সুবিধাই একতরফাভাবে দিয়ে এসেছে। কিন্তু চূড়ান্ত মুহূর্তে ভারত তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর না করে পিছু হটে যায়। বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পরও পরিস্থিতি পাল্টায়নি।
কেবল পানিপ্রাপ্তিতে ব্যর্থতাই নয়, পানি বণ্টন আলোচনায় কূটনৈতিক বিবেচনায়ও বাংলাদেশ বেশ পিছু হটে গেছে। এতো দিন সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারলেও দু’দেশের আলোচনায় পানির সংকট থাকতো এক নম্বর বিষয়। ওই অগ্রাধিকার এখন পাল্টে গেছে। আলোচনার টেবিলে প্রথম ও দ্বিতীয় বিষয় হয়ে উঠেছে ট্রানজিট এবং নিরাপত্তা প্রসঙ্গ। এতে বাংলাদেশের সরাসরি স্বার্থ জড়িত রয়েছে সামান্যই। দু’দেশের নীতি-নির্ধারক পর্যায়ে গত ৭ বছরের বৈঠকগুলো অনুসরণ করলে দেখা যায়, সিদ্ধান্ত যা হচ্ছে এর সবই ট্রানজিট ও নিরাপত্তা বিষয়ে। পরবর্তী এজেন্ডাগুলোর ক্ষেত্রে (পানি, বাণিজ্যিক ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদি) কেবল ‘আশাবাদ’ ব্যক্ত করা হচ্ছে। কূটনীতির ভাষায় তা একটি শূন্যগর্ভ শব্দ মাত্র।
পানি না দিয়েই করিডর
২০১০ সালে শেখ হাসিনার সফরকালে বাংলাদেশ-ভারত যে যৌথ ঘোষণা প্রচার করে এতে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি ২৭তম অনুচ্ছেদে স্থান পায়! দুই দশক ধরে ভারত চেষ্টা করছিল ‘পানির বিনিময়ে করিডর’ সুবিধা আদায় করে নিতে। এখন বাস্তবতা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ভারত ‘পানি না দিয়েই করিডর’ সুবিধা পেয়ে গেছে। কূটনীতিক সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার তিস্তার পানির বিষয়ে সম্ভাব্য একটি চুক্তির খসড়া ভারতীয়দের কাছে জমা দিয়েছিল। ভারতও একই বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য চুক্তির একটি খসড়া উপস্থাপন করে। তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ভারতীয় নীতি-নির্ধারকদের একটি অংশ বাংলাদেশকে তিস্তার প্রবাহের ৪৮ শতাংশ পানি দিতে চাইলেও অপর অংশ চূড়ান্ত পর্যায়ে আপত্তি তোলে এবং শেষ পর্যন্ত দিল্লিতে আপত্তিকারীদেরই জয় হয়।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এ পর্যন্ত পানি বিষয়ে একমাত্র চুক্তি হয়েছে গঙ্গার প্রবাহ নিয়ে। ১৯৯৬-২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এ বিষয়ে সর্বশেষ চুক্তি হয়। ওই আলোকে কূটনীতিবিদরা ভেবেছিলেন, পানি আলোচনায় এবারের আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও বোধহয় এক ধাপ অগ্রগতি ঘটবে, বিশেষত তিস্তার পানি নিয়ে। কিন্তু ২০১০ সালে শেখ হাসিনার ভারত সফর এবং ২০১১ সালে মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের পরও এরূপ কোনো চুক্তি না হওয়ায় এখন স্পষ্ট, আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানিতে বাংলাদেশকে ভারত আর কোনোভাবে ন্যায্য হিস্যার স্বীকৃতি দিতে চায় না।
তিস্তার পানি ও প্রবাহ
বাংলাদেশ দিয়ে প্রবাহিত আন্তর্জাতিক নদীগুলোর মধ্যে তিস্তা চতুর্থ বৃহত্তম। প্রায় ৪১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তার উৎপত্তি উত্তর সিকিমে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫ হাজার ৩০০ মিটার উঁচুতে। বাংলাদেশ-ভারত আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর মধ্যে তিস্তা বেশ খরস্রোতা। নীলফামারী দিয়ে এ দেশে ঢুকে কুড়িগ্রাম-গাইবান্ধা অঞ্চলে যমুনার সঙ্গে মিশে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিস্তা প্রায় ৮৩ মাইল পথ পাড়ি দিয়েছে। বাংলাদেশ অংশে তিস্তা বেশি শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত নয়। বর্ষায় এর দৈর্ঘ্য কমে যায়। কারণ সরাসরি প্রবাহিত হয়। গ্রীষ্মে প্রবাহিত হয় এঁকেবেঁকে। ফলে দৈর্ঘ্য তখন বেশি মনে হয়। তিস্তার পানির প্রধান উৎস বৃষ্টির পানি। এর ৮০ শতাংশ পায় নদীটি জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে। পানি বিজ্ঞানী খালেকুজ্জামান জানান, তিস্তার অববাহিকার আয়তন প্রায় ১২ হাজার বর্গকিলোমিটার এবং এর প্রায় ১৭ শতাংশ রয়েছে বাংলাদেশে। কিন্তু মানুষের হিসাবে চিত্রটি অন্য রকম। পুরো তিস্তা অববাহিকায় বসবাসরতদের ৫০ শতাংশই বাংলাদেশের মানুষ।
২০১৪ সালের শুকনো মৌসুমের অভিজ্ঞতা হলো, বাংলাদেশে তিস্তার প্রবাহ কখনো কখনো কমে দাঁড়ায় মাত্র ৪০০-৫০০ কিউসেকে (কিউসেক = প্রতি সেকেন্ডে এক ঘন ফুট)। অথচ পানি ও পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, তিস্তা বাঁচিয়ে রাখতে শুকনো মৌসুমে অন্তত ৩ হাজার ২০০ কিউসেক পানি বইতে দেয়া জরুরি। আবার বাংলাদেশের কৃষির অন্তত ১৪ শতাংশ এলাকায় তিস্তার পানি পাওয়াও জরুরি এক প্রশ্ন। এশিয়া ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় (পলিটিক্যাল ইকোনমি অ্যানালাইসিস অফ দি তিস্তা রিভার বেসিন ২০১৩) দেখানো হয়েছে, এ দেশের অন্তত ৭.৩ শতাংশ মানুষের জীবন-জীবিকা এখনো তিস্তা ঘিরে আবর্তিত।