‘জঙ্গিবাদের কথা বলে প্রতিপক্ষকে আ.লীগ কোণঠাসা করতে চায়’
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১২ নভেম্বর ২০১৫

মঞ্জুরুল আহসান খান বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)-র অন্যতম প্রবীণ নেতা ও সাবেক সভাপতি। ‘সাম্প্রতিক দেশকাল’-এর সঙ্গে তিনি সমকালীন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন নূরুর রহমান
ঘাতকরা আবারও হামলা চালিয়েছে। ব্লগারদের পর এবার তাদের লক্ষ্য প্রকাশকরা। একের পর এক হামলার জন্য সরকারের কি ব্যর্থতা আছে?
সরকারের একটি প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করা। সরকার ওই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। এ কারণে একের পর এক একই ধরনের হত্যাকা- হচ্ছে। বিগত সময়ের হামলাগুলোর একটিরও বিচার হয়নি। ফলে খুনিরা প্রশ্রয় পেয়ে যাচ্ছে। এছাড়া আমাদের মনে হচ্ছে, সরকার ও প্রশাসনেরও প্রশ্রয় আছে। তা না হলে একের পর এক হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না।
এর আগে আমরা দেখেছি, ক্রসফায়ারের ঘটনার বিচার হয়নি। ব্লগারদের হত্যার বিচার হয়নি। এরই ধারাবাহিকতায় কি এ জাতীয় হত্যাকাণ্ড?
বিচারহীনতার সংস্কৃতির জন্যই এভাবে একের পর এক হত্যাকাণ্ড চলছে। যদি বিচার হতো, অপরাধীদের শাস্তি হতো তাহলে এই জাতীয় হত্যাকাণ্ড বন্ধ হতো। আরো একটা কারণ হলো, সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, এ জন্য দায়ী বিএনপি। এ ধরনের দায়িত্বহীন মন্তব্যের ফলে তদন্তে বিঘ্ন ঘটবে, প্রকৃত অপরাধী আড়ালে থেকে যাবে। এমন দোষারোপের জন্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন হবে ঠিকই কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে প্রকৃত অপরাধী।
পশ্চিমা দেশগুলো ব্লগার বা বিদেশি হত্যাকাণ্ডের জন্য আইএস-কে দায়ী করছে। সরকার আবার ওই দাবির বিরোধিতা করছে। দায়ী করা বা না করার মধ্যে কোন রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে বলে মনে করেন?
রাজনৈতিক স্বার্থ তো অবশ্যই আছে। পশ্চিমাদের স্বার্থ হলো, এখানে ইসলামিক স্টেট (আইএস) বা জঙ্গিবাদ তৎপর- এ কথা বলে তারা বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও সামরিক হস্তক্ষেপ করতে চায়। এভাবে তারা এই দেশকে পরিপূর্ণভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করছে। যেমন- তারা করেছে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়া-য়। এ জন্য তারা দেখাতে চায় এখানে আইএস বা বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠী তৎপর। এক্ষেত্রে সরকার একটি দ্বিমুখী নীতি নিয়েছে। আগে তারা জঙ্গিবাদের কথা বলেছিল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে বিএনপিকে কোণঠাসা করার জন্য। তারা আসলে মৌলবাদটি নয়, বিএনপির রাজনীতিকে নির্মূল করার কাজে ব্যস্ত।
বাংলাদেশ ঘিরে আমেরিকা, চীন, ভারত, রাশিয়ার যে মেরুকরণ সৃষ্টি হয়েছে এটি আগামী দিনের রাজনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন?
বিশ্বজুড়ে একটি নতুন মেরুকরণ শুরু হয়েছে। পুতিনের জাতিসংঘে ভাষণ খেয়াল করলে দেখবেন, পৃথিবীতে এককেন্দ্রিক মেরুকরণের অবসান হয়েছে। সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে রাশিয়া। সাম্রাজ্যবাদ দুনিয়াজুড়ে যে আগ্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছে এর বিরুদ্ধে পাল্টা শক্তি দাঁড়াচ্ছে। এটি ভালো। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চাপ মোকাবেলা করার জন্য আমাদের এখন চীন-রাশিয়াসহ বিভিন্ন শক্তি কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।
ভারতীয় হাই কমিশনার বলেছেন, উন্নয়নের স্বার্থে ভারত ও বাংলাদেশকে হাতে হাত রেখে চলতে হবে এবং এর বিকল্প নেই। আপনিও কি এটিই মনে করেন?
ভারত আমাদের প্রতিবেশী। আমরা বন্ধু পরিবর্তন করতে পারি। কিন্তু প্রতিবেশী পরিবর্তন করতে পারি না। প্রতিবেশীর সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে এবং অর্থনৈতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমতার ভিত্ততে সহযোগিতা গড়ে তুলতে হবে। এর মাধ্যমে আমরা সাম্রাজ্যবাদের চাপ মোকাবেলা করতে পারবো। আমরা ভারতের সঙ্গে সহযোগিতা করবো, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলবো। ভারতও এতো দিন এটিই করেছে। তারা সাম্রাজ্যবাদের চাপ মোকাবেলা করার জন্য রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এভাবে নিজেদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছে। বাংলাদেশকেও ওই পথ যেতে হবে।
ভারতের সঙ্গে সহযোগিতা গড়ে তুলতে গিয়ে বাংলাদেশে কি অতিমাত্রায় ভারত নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছে না?
আমরা ভারতের বন্ধুত্ব চাই, প্রভুত্ব চাই না। আমাদের সম্পর্ক যেন সমতার ভিত্তিতে হয়। দুই দেশের যেন উপকারে আসে- এমনভাবে আমাদের নির্ধারণ করতে হবে। দু’দেশের মধ্যে এখনো কিছু বিষয়ে সমস্যা আছে, পানি নিয়ে আমাদের সমস্যা আছে, আরো যেসব বিষয়ে সমস্যা আছে সেগুলো আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সমাধান করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, ওই দু’দেশের মধ্যে বিভেদের সুযোগ অন্য কোনো দেশ যেন নিতে না পারে।
৫ জানুয়ারি নির্বাচন সম্পর্কে সিপিবি বলেছিল, ‘এটি পোকায় খাওয়া নির্বাচন’। কিন্তু নতুন নির্বাচনের ব্যাপারে সিপিবি এখন আর তেমন সোচ্চার নয় কেন?
৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে আমরা ১৫ দফা শর্ত দিয়েছিলাম নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার জন্য। এর মধ্যে সংখ্যানুপাতিক ভোটের কথাও বলেছিলাম। আমরা সরকারের কারসাজির নির্বাচনের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলাম। সেখানে যে টাকার খেলা হয় সেগুলো আমরা বন্ধ করার কথা বলেছিলাম। এর মধ্য দিয়ে আমরা একটা সুষ্ঠু নির্বাচন চেয়েছিলাম। সেসবের কিছুই হয়নি। এ জন্য আমরা বলেছিলাম, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন একটা পোকায় খাওয়া নির্বাচন। ওই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নয়। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে সরকার এসেছে এর নৈতিক শক্তি নেই। ফলে এখানে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়া দরকার।