
২০১৩ সালের জানুয়ারিতে প্রথম সংবাদটি এভাবে এসেছিল, ‘শিবির কর্মীদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ।’ তখন পটভূমি ছিল নির্বাচন নিয়ে বিবাদ। কেউ কেউ তখন সিদ্ধান্তটিকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। কারণ স্বস্তি দরকার ছিল তাদের।
এবার ঘোষণাটির পরিধি ব্যাপকতা পেয়েছে- ‘আক্রান্ত হলে পুলিশকে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ।’ অনেক গণমাধ্যম সংবাদটি আরো সহজবোধ্য করে ছেপেছে- ‘গুলির নির্দেশ।’ প্রশ্ন হলো, এরূপ ‘নির্দেশ’-এর সামাজিক ফল কতোটা ইতিবাচক? বার বার এমন নির্দেশ সমাজে স্বস্তির আবহ তৈরি করে কি না?
সাধারণত পুলিশের ভূমিকাকেন্দ্রিক তিনটি আইন রয়েছে দেশে- পুলিশ রেগুলেশন ১৯৪৩, পুলিশ আইন ১৮৬১ ও ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮। এ তিনটি আইন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পুলিশকে সতর্কতা এবং দায়িত্বশীলতার সঙ্গে আত্মরক্ষার কথাই বলে।
এটি ঠিক, ওই ধরনের নির্দেশ এবারই প্রথম শোনা যায়নি এ দেশে। সামরিক শাসন আমলে ‘কারফিউ’-এর সময় মরণ কামড়ের মতো এবং এরও আগে নকশালদের উদ্দেশ্যে ‘গুলির নির্দেশ’ দেখেছে বাংলাদেশে। তখন মওলানা ভাসানীর মতো অনেক নেতা এরূপ নির্দেশের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন। আজ আর তেমন প্রশ্ন উঠতে দেখা যায় না।
সর্বশেষ নির্দেশটি এসেছে পুলিশ নিহত হওয়ার পর। প্রতিটি হত্যাই অগ্রহণযোগ্য। সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সন্তানরাই ঝুঁকিপূর্ণ ও পরিশ্রমসাধ্য এ পেশায় আসছেন। আত্মরক্ষার অধিকার আছে তাদেরও। কিন্তু আইনের চোখে পুলিশ হত্যা মোকাবেলায় আলাদা কোনো ব্যবস্থাপত্র নেই। সবার সুরক্ষার জন্য যে বিধান, পুলিশের ক্ষেত্রেও তা-ই প্রযোজ্য।
আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় পুলিশ জনগণের বড় বন্ধু। পুলিশের কাজ জননিরাপত্তা কায়েম। ১৯৪৩ সালের রেগুলেশন অনুযায়ী অবৈধ সমাবেশ থেকে লোকজনকে সরাতে গিয়েই কেবল গুলি করা যায় এবং তাও ম্যাজিস্ট্রেট বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে। একই আইনের ১৫৩ নম্বর রেগুলেশন অনুযায়ী ওই গুলিও কেবল সতর্কবাণী জানিয়েই করা যায়। আবার জাতিসংঘ হিউম্যান রাইটস কমিশনের এ সংক্রান্ত গাইডলাইন (১৯৯০) অনুযায়ী উপরোক্ত পরস্থিতিতেও নন-লেথাল অস্ত্রই কেবল প্রয়োগ করা যাবে এবং ড্যামেজ যাতে ন্যূনতম হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এও বলা হয়েছে, অপ্রয়োজনীয় বল প্রয়োগের দায়িত্ব একটি দেশের সরকারকেই বহন করতে হবে। বস্তুত এমন কোনো আইনি ব্যবস্থা নেই যে, পুলিশ নিজে থেকে গুলি চালিয়ে দিতে পারে। উচ্ছৃঙ্খল সমাবেশ যখন কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যায় না তখন সতর্কবাণীর পরই কেবল ন্যূনতম মাত্রায় প্রতিকারমূলক ভূমিকা নেয়া যায়। গুলি চালানো একটি চরমপন্থী ব্যবস্থাপত্র। মনে রাখা দরকার, গুলি ও গুলিবর্ষণকারী- উভয়ই জনগণের আর্থিক অবদানে জননিরাপত্তার জন্যই দায়িত্বপ্রাপ্ত।
বাংলাদেশে এ রকম সতর্কবাণী কতোটা গুরুত্ব পাবে তা বলা মুশকিল। কারণ ‘সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ’-এর সংস্কৃতি এখানে অত্যধিক গুরুত্ব পাচ্ছে। এমনকি কিছুদিন আগে প্রয়াত এক মন্ত্রীর কথা মনে পড়ছে যিনি ‘কোর্টে বিচার করার দরকার নেই’ বলেও মনে করতেন। এই মনোভাব বিপজ্জনক। তার অভিজ্ঞতা হিসেবে টাঙ্গাইলের কালীহাতিতে কিছুদিন আগে নিরস্ত্র নাগরিকদের হত্যাকা-ের কথা স্মরণযোগ্য। সেখানে বিশ্বাসযোগ্য হুমকি ছাড়াই জনগণের ওপর গুলি ছোড়া হলে চারজন মারা যান।
মনে হচ্ছে, বল প্রয়োগেই রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখতে হবে- এ প্রবণতাই গুরুত্ব পাচ্ছে। দুঃখজনক হলো, ঔপনিবেশিক পুলিশি সংস্কৃতি দিয়েই ‘স্বাধীনতা-উত্তর’ রাষ্ট্রটি টিকিয়ে রাখতে হচ্ছে। এখানে জনগণ ক্রমেই বিবেচিত হচ্ছে প্রতিপক্ষ হিসেবে। কিন্তু এ দেশের জন্য পুলিশ ও জনগণ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছিল। বিজয়ের ওই মাস সামনে রেখে আমরা এটিই কেবল বলবো, যে হিংসা আশ্রয়ী রাজনীতি রাষ্ট্র ও জনগণকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাচ্ছে এর সংস্কার করতে হবে। আগ্নেয়াস্ত্র নয়, আন্তরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই সেটি সম্ভব।