
বার বার দীপনের কথা মনে পড়ছে। দীপন প্রকাশনা জগতে ছিল এবং সে প্রকাশনা জগতে নিজ ইচ্ছায় এসেছিল। এই যে আক্রমণটা এলো, সেটি হলো প্রকাশনা জগতে। অর্থাৎ এখন প্রকাশনা জগৎকে ভয় পাইয়ে দেয়া যে, তারা যেন ওই ধরনের বই অর্থাৎ কোনো রকমের মুক্তচিন্তা ও প্রগতিশীল চিন্তার বই প্রকাশ করতে না পারে।
এ অপরাধটা কোনো সাধারণ অপরাধ নয়। এই অপরাধ ফৌজদারি অপরাধ নয়, দেওয়ানি অপরাধ নয়, খুন-রাহাজানি-ছিনতাই নয়। এ অপরাধটা হলো রাজনৈতিক অপরাধ এবং এই রাজনৈতিক অপরাধটা হলো রাষ্ট্রের ভিত্তির ওপর আক্রমণ। এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে। এর ভিত্তিটাই নষ্ট হয়ে গেছে।
যারা আক্রমণটা করছে তারা বিভ্রান্ত। তারা জানে না, যেটা ইসলামের নামে করছে সেটি ইসলামের বিরুদ্ধে করছে, দেশের নামে করছে। কিন্তু সেটি দেশদ্রোহী কাজ করছে।
তারা এখন এখানে রাষ্ট্র দখল করতে চাইছে। তারা রাষ্ট্র ক্ষমতা কখনোই দখল করতে পারবে না, রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করবে আধিপত্যবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীরা। তারা আমাদের এখানে চোখ রেখেছে- যেমন করে তারা মধ্যপ্রাচ্যে গেছে অজুহাত নিয়ে তেমনি বাংলাদেশেও আসবে। কারণ বাংলাদেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারলে তাদের নানান দিক থেকে সুবিধা। রাজনৈতিক দিক থেকে সুবিধা। এ জায়গাটা বিপজ্জনক জায়গা। এ জায়গাটা যাতে কমিউনিস্টদের হাতে না চলে যায়। কারণ এখনো তাদের কমিউনিস্টদের প্রতি ভয় আছে।
দেখা যাচ্ছে, এ বিষয়ে রাষ্ট্র ও সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে না। রাষ্ট্র বুঝতে পারছে না এই অপরাধের পরিধি, গভীরতাÑ দুটিই ক্রমে বাড়ছে এবং তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ঘটনাগুলো যদি আমরা দেখি তাহলে দেখবো, লেখক-প্রকাশকদের ওপর আক্রমণ হলো, শিয়া-সুন্নির মধ্যে বিরোধ সৃষ্টির চেষ্টা হলো। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন কখনোই ঘটেনি। শিয়াদের আলাদাভাবে দেখা বা তাদের ধর্মীয় কোনো উৎসবে আক্রমণ কখনোই হয়নি।
এর মানে একটা অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে। যেখানে তারা ভাবছে, তারা ক্ষমতা দখল করতে পারবে। এই জঙ্গিরা তা করতে পারবে না। তারা অজুহাত তৈরি করে দেবে অন্যদের এখানে আসতে।
এর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ দরকার এবং ওই প্রতিরোধটা রাজনৈতিক প্রতিরোধ হতে হবে। ওই প্রতিরোধটা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিরোধ নয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারছে না, করছেও না এবং করবেও না।
রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করার জন্য জনগণকে সঙ্গে নিতে হবে। সরকারটা এটা পারছে না, পারবেও না। জনগণকে সরকার নিতে পারছে না। কারণ সরকারের সঙ্গে জনগণ নেই। সরকার গণবিচ্ছিন্ন। সরকারের কাজকর্মের কারণে মানুষ রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়ছে। রাজনৈতিক বিমুখতার কারণ হলো, সরকারের ওপর জনগণ আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। মানুষের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। এতে জঙ্গিদের সুবিধা হচ্ছে।
এটা খুব বিপজ্জনক পরিস্থিতি। তাই প্রতিরোধটা সর্বাত্মক হতে হবে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন যেভাবে হয়েছিল। নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সূত্রপাত করেছিল এ আন্দোলন। তখন ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল মানুষ সর্বদলীয়ভাবে। তখন সরকারের বিরুদ্ধে সর্বদলীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখন সরকারের উচিত সব দলের লোকজন নিয়ে এক সঙ্গে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। এই প্রতিরোধ যদি গোড়ে তোলা না হয় তাহলে এ রকম পরিস্থিতিতে আমরা চলে যাবো যেখানে থেকে ফেরত আসা কঠিন হবে।
এ শক্তিটা বাড়তে থাকবে এবং যারা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে তারা যে আন্তর্জাতিকভাবে সহায়তা পাচ্ছে এতে সন্দেহ নেই। সাম্রাজ্যবাদীরা ধর্মীয় উন্মাদনা কাজে লাগাচ্ছে। তারা মনে করে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা রক্ষা করতে হলে ধর্মীয় গোষ্ঠীদের সঙ্গে নিতে হবে। এই ধর্মীয় গোষ্ঠীদের সঙ্গে পুঁজিবাদের কোনো পার্র্থক্য নেই। তারা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা রক্ষা করতে চায়। উভয়ই তারা বিদ্যমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বাইরে নয়। তাদের শত্রু হচ্ছে প্রগতিশীল সমাজতন্ত্রীরা।
পরিস্থিতির গুরুত্ব না বুঝলে অরাজকতা বাড়বে এবং ওই অরাজকতা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। রাষ্ট্রের যারা শাসক মানে, সরকার- তারা এটাকে বিপদ মনে করছে না। তাদের যে প্রতিদ্বন্দ্বী মানে বিএনপি, তাদের শত্রু মনে করছে তারা। কিন্তু বিএনপির অবস্থান যতো সংকুচিত হবে ততো জঙ্গিদের অবস্থান জোরালো হবে। মানুষ তো সরকারের একটা বিপরীত শক্তি চাইবে। এরূপ শক্তি আর বাম দিক থেকে আসছে না। আগে শাসক শ্রেণীর ভয় থাকতো বামপন্থীদের নিয়ে। চরমপন্থীরা এখন ডান দিক থেকে আসবে। ডান চরমপন্থীদের আমাদের শাসকরা শত্রু মনে করে না। ডান দিকের ওই জঙ্গিরা ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিরুদ্ধে নয়। তারা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে নয়। বিদ্যমান ব্যবস্থার মূল জায়গাটা হলো অর্থনৈতিক। এ জায়গাটা ওই শক্তি যে ভেঙে ফেলবে তা নয়, ব্যবস্থাটা রাখবে। ওই ব্যবস্থাটায় যে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হবে এবং যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি হবে- তারা অনেক কাজ করবে। যেমনÑ প্রথমে ব্লাশফেমি আইন করবে। কোনো কথাই বলা যাবে না। দু’দিক থেকে তারা প্রগতিশীলদের শত্রু মনে করবে। তারা ধর্মনিরপেক্ষতা ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির সংকোচন চায়।
কেবল সরকার নয়, বুদ্ধিজীবীরাও ব্যাপারটা বুঝছেন না। ১৯৭১ সালে আমাদের কোনো নিরাপত্তা ছিল না। ওই রকম নিরাপত্তাহীনতার জায়গায় পৌঁছে যাবো যদি আমরা জঙ্গিদের প্রতিহত করতে না পারি এবং প্রতিহত করতে হবে রাজনৈতিকভাবে, মতাদর্শিকভাবে।
সাংস্কৃতিক কাজগুলো ভয়াবহভাবে অবহেলা করা হচ্ছে। এখানে যে পাঠাগার দরকার, নাটক-গান, মানুষের মেলামেশা দরকার, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্র সংসদ দরকারÑ এর সব অবরুদ্ধ হয়ে গেছে। সব অবরুদ্ধ হওয়ার ফলে পোকামাকড় তৈরি হয়েছে। বদ্ধ পুকুরে যা হয়।
বুদ্ধিজীবীদের এই পরিস্থিতির গভীরতা চিন্তা করতে হবে। ব্যবস্থাটা এ রকমভাবে চলতে থাকলে বিপদটা ভয়ঙ্কর অবস্থা ধারণ করবে। আর সরকারকে বুঝতে হবে, তারা মানুষের মত প্রকাশের ওপর যেভাবে হস্তক্ষেপ করছে, তারা যে রকম কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করছে- সেটিও অশুভ লক্ষণ। কথা বলার সুযোগ দিতে হবে। গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে এবং প্রতিরোধের জন্য যে পরিবেশ দরকার তা হলো গণতন্ত্র।