
ওয়ার অন টেররের যুগে বর্তমান শাসন আমলে এসে বাংলাদেশে ‘নিরাপত্তা বিশ্লেষক’ শব্দটি দিনকে দিন তামাশা হয়ে উঠছে। দৈনিক প্রথম আলো অক্টোবর মাসে এমনই এক জার্মান বিনোদনদাতা মানে, কথিত ‘নিরাপত্তা বিশ্লেষক’ ড. সিগফ্রিড ও. উলফ-এর দুটি সাক্ষাৎকার ছেপেছে। প্রথমবার ১ অক্টোবর সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের জঙ্গিবাদের মূল হোতা সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এইচএম এরশাদ।’ নিঃসন্দেহে আকাশ থেকে পড়ার মতো এক আজব বক্তব্য এটি।
যে কোনো রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে সমালোচনা থাকা স্বাভাবিক। ফলে জিয়া ও এরশাদের বিরুদ্ধেও রাজনৈতিক বিভিন্ন সমালোচনা আছে। কিন্তু তারা ‘জঙ্গিবাদের হোতা’ ছিলেনÑ এমন অভিযোগ বাংলাদেশের কারো ছিল না, কেউ শোনেননি। বিশেষত যখন জঙ্গিবাদ শব্দ চালু হয়েছে- একালে ২০০১ সাল থেকে আল কায়দা ফেনোমেনা হাজির হওয়ার পর। আমেরিকার হাতে পড়ে ‘জঙ্গিবাদ’ বা ‘টেররিজম’ শব্দের বিশেষ অর্থ এখন ‘ইসলামি সন্ত্রাসী’।
জিয়া বা এরশাদের জমানায় জঙ্গিবাদ বলে কোনো নেতিবাচক শব্দ ছিল না, বরং ১৯০৫ সালে সূর্য সেনদের আমল থেকে বাংলায় ‘ত্রাস সৃষ্টি’ বা ‘সন্ত্রাসবাদী রাজনীতি’- এসব শব্দ ইতিবাচক অর্থ বহন করতো। একালে ২০০১ সাল থেকে আমাদের ভাষায় টেররিজম শব্দের বাংলা হয়েছে জঙ্গিবাদ। তখন থেকে এই শব্দের নেতি অর্থে ব্যবহার। লাইন টেনে ভাগ করে বলতে গেলে ২০০১ সালে দুনিয়ায় আল কায়দা ফেনোমেনা হাজির হওয়ার আগে টেরর শব্দটা ইতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হতো। যেমনÑ জাসদের ‘জঙ্গি মিছিল’ অথবা ছাত্র বা শ্রমিকদের ‘জঙ্গি মিছিল’ হতে দেখতাম আমরা। জোশ, উচ্ছ্বাস কিংবা ডিটারমিনেশন বা লড়াকু দাবি বোঝানোর জন্য এবং ইতিবাচক ভাবের জন্য জঙ্গি শব্দ ব্যবহার করা হতো। বিপ্লব সংগঠিত করার সময় শহুরে পেটিবুর্জোয়াদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করে তাদের বিপ্লবীদের পক্ষে রাখা অথবা না হলে নিরপেক্ষ রাখার উপায় হিসেবে ‘আরবান টেরর’ বা ত্রাস সৃষ্টির কথা বোঝাতে কমিউনিস্ট লিটারেচারে ইতিবাচক অর্থে ‘লাল সন্ত্রাস’ শব্দ খোলাখুলি ব্যবহার হতো।
জিয়া বা এরশাদের আমলে আজকের অর্থে জঙ্গিবাদ বলে কোনো ভাব বা অর্থ ছিল না। বরং বিনোদনদাতা বিশ্লেষক সিগফ্রিড ২০০১ সালের পরের একটা ধারণা আগের সময়ের ইতিহাসে জিয়ার (১৯৭৫-৮১) বা এরশাদের আমলের (১৯৮২-৯০) বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন। দ্বিতীয়ত. টেররিজম বা জঙ্গিবাদ শব্দের ব্যবহারকারীরা প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে যে দুই বৈশিষ্ট্যসূচক অর্থে এই শব্দ ব্যবহার করেন তা হলো ‘ইসলামি সন্ত্রাসী’। সিগফ্রিড-ও কী ইসলামি সন্ত্রাসী অর্থে ব্যবহার করেছেন?
সিগফ্রিড ওই সাক্ষাৎকারে পরে আরো বলছেন, ‘তাদের উভয়ের স্বৈরশাসন আমলে সংবিধানে পরিবর্তন এনে সেকুলার নীতি আমূল বদলে ফেলা হয়েছে। কারণ তারা ধর্মের কার্ড খেলে নিজেদের ক্ষমতার বৈধতার ঘাটতি পূরণ করতে সচেষ্ট হয়েছেন। সন্দেহাতীতভাবে তারা পাকিস্তানি সামরিক জান্তা জেনারেল জিয়াউল হককে গুরু মেনেছেন। তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন।’ এসব পড়ে পাঠকের চেনা চেনা ভাষা মনে হতে পারে। মনে হতে পারে স্থানীয় বিশেষ কোনো দলের সমর্থক বুদ্ধিজীবীর ভাষ্য শুনছি।
সিগফ্রিড এখানে জিয়া ও এরশাদ- উভয়ের শাসন আমলে তিন অপরাধের কারণে তাদের ‘জঙ্গিবাদের হোতা’ বলে অভিযোগ করছেন। এক. সেকুলার নীতি আমূল বদলে ফেলা, দুই. ধর্মের কার্ড খেলে নিজেদের ক্ষমতার বৈধতার ঘাটতি পূরণ, তিন. সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম আনা এবং জাতীয় রাজনীতির পাদপ্রদীপে ধর্মকে আনা।
আগেই বলেছি, জঙ্গিবাদ বলতে ‘ইসলামি সন্ত্রাসী’ বোঝানো হয় এখন। কিন্তু টেররের বাংলা জঙ্গি বা সন্ত্রাসী হলেই তো যথেষ্ট। তবু সন্ত্রাসী শব্দের আগে ইসলামি বিশেষণ যোগ করার দরকার এ জন্য যে, সুনির্দিষ্ট করে কেবল ইসলামি সন্ত্রাসীর কথাই পশ্চিমারা বোঝাতে চায়। অর্থাৎ কমিউনিস্ট সন্ত্রাসী বা ক্রিশ্চিয়ান সন্ত্রাসী (যেমন আয়ারল্যান্ডে)- তাদের কথা তারা বোঝাতে চান না।
মূল ফোকাস ‘সন্ত্রাস’ হলেও এই ‘সন্ত্রাসবাদ’ ইসলামি বা মুসলমানদের যদি হয় তাহলে একমাত্র সেক্ষেত্রেই তা জঙ্গিবাদ বা টেররিজম। যেমন- মিসরের আরব স্প্রিংয়ের মোবারক খেদানো আমেরিকার সংজ্ঞায় ‘জঙ্গিবাদ’ নয়। কারণ এটা ইসলামি হলেও সন্ত্রাসী নয়। একইভাবে তিউনিসিয়ায়ও রাজনৈতিক তৎপরতা ‘জঙ্গিবাদ নয়’।
এ কারণে জিয়া ও এরশাদের বিরুদ্ধে সিগফ্রিড-এর অভিযোগগুলো পশ্চিমের চোখে ‘সন্ত্রাসী’ কাজ নয়। তবে এটিকে ইসলামি রাজনীতি বলে চিহ্নিত করতে পারেন কেউ। অর্থাৎ সিগফ্রিড-ই জঙ্গি বা ইসলামি সন্ত্রাসী প্রসঙ্গে পশ্চিমের সংজ্ঞা মানছেন না। অথচ নিজেকে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ বলে দাবি করতে চাইছেন। এ ধরনের কাজটিকে বলে অন্য কারো এজেন্ট হয়ে কাজ করা। এক ধরনের তামশাও বলা যায় এটিকে।
আসল ২০০১ সালের আগে ‘জঙ্গিবাদ’ বলে কোনো রাজনীতি ছিল না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামের প্রভাব বাড়ার বিষয় ঘটেছিল। সেটিকে ‘জঙ্গিবাদ’ বলে চেনানো হয় না, হয়নিও। কমিউনিস্টরা নিজেই ইসলামের ওই প্রভাবটিকে জঙ্গিবাদ বলে চিহ্নিত করেনি। আশি বা নব্বইযের দশকের বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটিকে তারা বলতেন ‘মৌলবাদী’ বা ‘ইসলামি মৌলবাদী’ রাজনীতি।
তাহলে ড. সিগফ্রিড ও. উলফ বাংলাদেশে নতুন কী নিয়ে হাজির হয়েছেন? তিনি জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা একাডেমিক স্টাডি সেন্টার খুলেছেন যার বিষয় এশিয়ায় পশ্চিমা দেশের নিরাপত্তা স্বার্থ। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সম্ভবত এ অঞ্চলের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ব্যাখ্যা, তথ্য ও ব্রিফিংয়ের জন্য তিনি পার্শ্ববর্তী কোনো দেশের গোয়েন্দা বিভাগের ওপর এবং ওই সূত্রে স্থানীয় চেনামুখ ভাষ্যকারদের ওপর একপেশেভাবে নির্ভর করেছেন। তিনি দিল্লির সেন্টার দি সায়েন্সেস হিউম্যানসের সাবেক রিসার্চ ফেলো ছিলেন। অনুমান করি, নিজের সব আক্কেল তিনি তখনই খুইয়েছেন।