ধর্মের সহাবস্থানেই সামাজিক সাম্য নিশ্চিত হয় না
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১২ নভেম্বর ২০১৫
রোমিলা থাপার

প্রফেসর রোমিলা থাপার প্রাচীন ভারতের ইতিহাস বিষয়ে পণ্ডিত। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ইতিহাস বিভাগের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার ‘পদ্মভূষণ’ প্রত্যাখ্যান করেছেন রাষ্ট্রের কাছ থেকে পুরস্কার নেবেন না বলে। সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয়েছে ‘দি নিউজ সানডে’ অনলাইন সংস্করণ থেকে। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারিতে। এখানে এর নির্বাচিত অংশ ভাষান্তর করেছেন জাভেদ হুসেন
সেকুলার ভারত হিন্দু হয়ে উঠছে কেন?
তা এক লম্বা কাহিনী। এর শুরু ওই সময় যখন উপনিবেশবিরোধী সেকুলার জাতিয়তাবাদ ছিল। তবে এর সঙ্গে আরো ছোট দুটি আন্দোলন ছিল- একদিকে মুসলিম ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ নিয়ে মুসলিম লীগ, অন্যদিকে হিন্দু জাতীয়তাবাদ নিয়ে হিন্দু মহাসভা। মুসলিম ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ এক হিসেবে পাকিস্তান সৃষ্টি করে সফল হলো। হিন্দু ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ নিয়ে যারা মেতে ছিলেন তারাও চাইলেন ভারতে যেন একই রকমের রাজনৈতিক রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। জাতীয় আন্দোলনে তখন সেকুলারিজমের প্রতি কমিটেড যথেষ্ট মানুষ থাকায় তা হলো না, ভারত সেকুলার রাষ্ট্র রয়ে গেল।
আজ যা ঘটছে এর অংশত কারণ হলো, গত কয়েক দশকে যে পথে উন্নয়ন ঘটছে এতে মোহমুক্তি। এ কারণে বিগত সরকারগুলো যে মূল্যবোধ তুলে ধরতো তা থেকেও মুখ ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। এখন নতুন মূল্যবোধের সম্ভাবনায় আশাভরে তাকিয়ে থাকা আছে। মজার ব্যাপার, বর্তমান সরকার নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছে উন্নয়নের ইস্যু নিয়ে এবং ক্ষমতায় আসার পর থলে থেকে অন্য বিড়াল বের হচ্ছে। রাষ্ট্র ও সমাজে এক ধরনের ’হিন্দুত্ব’ আরোপের চেষ্টা হচ্ছে। নিরাপত্তাহীনতার সময় মানুষ সহজ সমাধান খোঁজে। হিন্দু নাগরিককে প্রাধান্য দেয়ার ধারণাটি ওই সহজ সন্ধানীদের কাছে আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে।
আপনার কী মনে হয়, নিও-লিবারেলিজম, ব্যবসা ও ধর্মের সমন্বয় ভয়ানক এবং গণবিরোধী?
হ্যাঁ, গুরুতর। কারণ নিও-লিবারেলিজমের মানে হলো ব্যাপারটি ব্যাক্তিগত উদ্যোগের হাতে ছেড়ে দেয়াÑ তা বিনিয়োগই হোক বা অন্য কোনো উপায়ে টাকা রোজগারই হোক। আর অবশ্যম্ভাবী সংঘাতটা হলো, আদর্শতাড়িত হিন্দু রাষ্ট্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় নিয়ম-কানুন অনুসরণে কঠোর হতে হবে যা অর্থনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। মনে হয়, সামনে আমরা এই সংঘর্ষের ফল দেখতে পাবো।
এই রাষ্ট্রের প্রধান দাবি ছিল সেকুলারিজম। এমন দেশে সেকুলার শক্তি দুর্বল হয়ে গেল কেন?
সেকুলাররা ধরে নিয়েছিল, সেকুলারিজম পাকাপাকিভাবে আসন নিয়েছে। রাষ্ট্র সেকুলার হওয়ায় তারা নিশ্চিন্ত হয়ে গিয়েছিল। সেকুলার সমাজের আসল মানে কী, জনগণকে তা বোঝাতে তারা যথেষ্ট কাজ করেনি। এর জন্য কেমন আইন প্রয়োজন তা নিয়েও কাজ হয়নি। ভারতে সেকুলারিজমের যে ভিন্ন সংজ্ঞা আছে তা আমার কাছে যথার্থ বলে মনে হয় না। সেকুলারিজমটিকে সব ধর্মের সহাবস্থান হিসেবে ধরে আমরা আলোচনা করি। এটি যথেষ্ট নয়। সব ধর্মের সহাবস্থান থাকলো। কিন্তু সামাজিক সাম্য থাকলো না। তাহলে তো হলো না। ধর্মের সহাবস্থান থাকলেই সামাজিক সাম্য নিশ্চিত হয় না। আমরা সহাবস্থানে বিশ্বাস করেছি আবার কিছু ধর্মের আধিপত্যশীল ভূমিকাও মেনে নিয়েছি। এখানেই আমাদের ঘাটতি।
আপনার মতো করে ভাবছে এমন মানুষ বা এমন কোনো আন্দোলন কী আছে?
এমন করে ভাবছেন এই মুহূর্তে এমন কয়েক ব্যক্তি আছেন। তবে তেমন কোনো আন্দোলন নেই আমি যতোটুকু জানি।
অবস্থা তাহলে দুঃখজনক-
হ্যাঁ, আজকাল যাকে ‘হিন্দু মৌলবাদ’ বলা হয়, এর তো বেশ বাড়বাড়ন্ত দেখা যাচ্ছে। হিন্দু মৌলবাদ ধারণাটি ধর্মীয় পরিভাষায় পরস্পর বিরোধী হতে পারে। তবে রাজনৈতিক অর্থে ভালোই কাজ চলে যায়। অবস্থা যা, এতে তো খুশি হওয়ার কিছু নেই। একই সঙ্গে এও মনে রাখতে হবে, অবস্থা খারাপ হলে পাল্টা জবাব আসতে বাধ্য। আশা করি, ওই পাল্টা জবাবের আমরা মুখোমুখি হতে পারবো। বিরোধী করার মানুষও তো আছে।
বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভারতে সেকুলারিজমের ভবিষ্যৎ কী? অবস্থা কি বদলাবে?
অবশ্যই, অবস্থা তো বদলাতে বাধ্য। গণতন্ত্র হিসেবে যদি টিকতে চাই শেষ পর্যন্ত তাহলে সেকুলার হওয়া ছাড়া উপায় নেই, অন্য কোনো পথও নেই।