
(গত সংখ্যার পর)
আবুল হাশিম ৩০ এপ্রিল এক বিবৃতিতে অখ- বঙ্গদেশ প্রতিষ্ঠার বিরোধী বক্তব্য খণ্ডন করেন। ১১ মে আবুল হাশিম ও শরৎচন্দ্র বসু গান্ধীর সঙ্গে এ বিষয়ে মতবিনিময় করেন। সোহরাওয়ার্দী ও ফজলুর রহমানও এ বিষয়ে গান্ধীর সঙ্গে কথা বলেন। ১৫ মে তারা দিল্লিতে মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর সঙ্গেও কথা বলেন। ৩০ এপ্রিল মুসলিম লীগ সাব-কমিটির সদস্যরা, প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী এবং কিরণ শঙ্কর রায় ও শরৎ বসু কয়েক দফা মিলিত হয়ে স্বাধীন বঙ্গদেশ সম্পর্কে আলোচনা করেন। ১৯৪৭ সালের ২০ মে শরৎ বসুর বাড়িতে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে হিন্দু ও মুসলিম নেতৃবৃন্দের অবিভক্ত বাংলা (United Bengal) সম্পর্কে একটা বোঝাপড়া হয়। ঐকমত্যের ভিত্তিতে স্থির হয়-
এক. বাংলা হবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। স্বাধীন বাংলা ভারতের অন্যান্য অংশের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণ করবে। স্বাধীন বাংলা হবে একটি সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র।
দুই. স্বাধীন বাংলার সংবিধান অনুযায়ী বাংলা আইন পরিষদ সংগঠিত হবে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে এবং যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতিতে নির্বাচিত সদস্য সমন্বয়ে। হিন্দু ও মুসলিম সদস্য সংখ্যা নির্বাচিত হবে জনসংখ্যার ভিত্তিতে অথবা সর্বসম্মতিক্রমে।
তিন. স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র হিসেবে ব্রিটিশরাজ কর্তৃক স্বীকৃত হলে বর্তমান মন্ত্রিসভা ভেঙে যাবে এবং প্রধানমন্ত্রী ছাড়া সমসংখ্যক মুসলমান ও হিন্দু (তফসিলি সম্প্রদায়সহ) মন্ত্রীর সমন্বয়ে অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রী হবেন মুসলমান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন হিন্দু।
চার. নতুন সংবিধান অনুযায়ী আইন পরিষদ এবং মন্ত্রিপরিষদ গঠিত না হওয়া সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বিভাগসহ সব বিভাগে হিন্দু-মুসলমানরা সমান হারে নিয়োগ লাভ করবেন। সব পদে থাকবে বাংলার জনগণ।
পাঁচ. সংবিধান রচনার জন্য ৩০ সদস্যের একটি গণপরিষদ গঠিত হবে। সদস্যদের মধ্যে ১৬ জন হবেন মুসলমান ও ১৪ জন হিন্দু। প্রাদেশিক পরিষদ কর্তৃক তারা নির্বাচিত হবেন।
ছয়. ১৯৪৮ সালের জুন বা এর আগে ব্রিটিশরাজ স্বাধীন বাংলা সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।
বঙ্গীয় মুসলিম লীগ ও বঙ্গীয় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ অখ- বঙ্গদেশ আন্দোলনের সূচনা করলে কয়েক বাঙালি নেতা এবং সর্বভারতীয় অবাঙালি নেতৃত্ব এর বিরোধিতা করেন। হিন্দু মহাসভা নেতা শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি ১৯৪৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এক বিবৃতির মাধ্যমে বঙ্গভঙ্গের দাবি করেন। ৫ এপ্রিল তারকেশ্বরে তিনি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা সমন্বয়ে হিন্দু-বাংলা গঠনের দাবি করেন। ওই দাবির পক্ষে মত প্রকাশ করে সর্বভারতীয় নেতা আচার্য কৃপালনী বিবৃতি দেন ১৯৪৭ সালের মার্চে। জওহরলাল নেহরু, পুরুষোত্তম দাস ট্যান্ডন, সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল বাংলা বিভক্ত করার দাবিটি সর্বভারতীয় হিন্দু দাবিতে রূপান্তরিত করেন।
ইতিহাসের নির্মম পরিহাস, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ করার জন্য বাংলার ভেতরে এবং সর্বভারতীয় পর্যায়ে যারা এক অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন গড়ে তোলেন ও ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে সরকারকে বাধ্য করেন তারাই এবার বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের নেতৃত্বে এগিয়ে এলেন। বঙ্গীয় হিন্দু-মুসলিম নেতারা বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ করা প্রায়স পেয়েছিলেন বাংলার দূরদর্শী বিচক্ষণ নেতা চিত্তরঞ্জন দাসের সময় থেকে। তিনি বেঙ্গল প্যাক্ট (Bengal Pact) তৈরি করে এগিয়ে আসেন। এবারের বঙ্গীয় কংগ্রেস নেতা সুরেন্দ্র মোহন ঘোষ, কিরণচন্দ্র রায় প্রমুখ নেতা এগিয়ে এসে হাত মেলালেন সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের সঙ্গে। কিন্তু তা সফল হয়নি। মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ জানান, এক্ষেত্রে তার আপত্তি নেই। তবে শরৎচন্দ্র বসুর লিখিত চিঠির উত্তরে মহাত্মা গান্ধী বলেন, ‘অখ- বঙ্গদেশ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা আপনার ত্যাগ করা উচিত।’ অবিভক্ত বাংলার প্রস্তাবটি একটি কৌশল হিসেবে চিহ্নিত করে ১৯৪৭ সালের ২৩ মে প্যাটেল লিখেছিলেন, ‘বাংলার অমুসলিম জনসমষ্টিকে বাঁচানোর জন্য বাংলার বিভক্তকরণ অপরিহার্য (Bengal has got to be partitioned if the non-Muslim population has to survive)। শ্যামা প্রসাদ বাংলার বিভক্তিকরণ চেয়েছিলেন দুটি কারণে, এক. ‘অবিভক্ত বাংলায়’ তার কথায়- ‘নিম্নবর্ণ হিন্দুদের ধর্মান্তকরণের ফলে যেভাবে জনসমষ্টির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মুসলমান হয়েছে এতে তাদের আধিপত্য অসহ্য, নয় কী? দুই. বাংলা যদি বিভক্ত হয় তাহলে বিতর্কিত রাষ্ট্র হিসেবে পূর্ব বাংলা দুই বা তিন মাসও টিকে থাকবে না।
বঙ্গদেশ শেষ পর্যন্ত বিভক্ত হয়। পূর্ব পাকিস্তানরূপে পূর্ববাংলা টিকে থাকে ২৪ বছর। পাকিস্তানের জ্বলন্ত জঠর থেকে পূর্ব পাকিস্তান প্রাণ পেয়েছে বাংলাদেশরূপে। মুখার্জির ভবিষ্যৎ বাণীটি মিথ্যা প্রমাণিত করে স্বাধীন বাংলাদেশও টিকে রয়েছে এবং টিকে থাকবে।
এ দেশেরও কেউ কেউ দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরুদ্ধে কথা বলে নিজেদের অজ্ঞতাটি সুস্পষ্ট করে থাকেন। তারা ইতিহাসের পাঠ গ্রহণ করেননি। সমাজ ব্যবস্থার চালচিত্র সম্পর্কেও তারা সঠিকভাবে অবগত নন। তাদের জানতে হবে, বহুজাতির ভারতকে যারা শুধু এক জাতি বা শুধু হিন্দুদের রাষ্ট্র বলে দাবি করছেন, এরই প্রতিক্রিয়া দ্বিজাতি তত্ত্ব ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান- যখন শুধু পশ্চিম পাকিস্তানিদের স্বার্থে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়েছে তখনই পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়েছে। তাদের অনুধাবন করতে হবে, বাংলাদেশেও রয়েছে বহু জাতিসত্তার মানুষ। বাংলাদেশ শুধু বাঙালির রাষ্ট্র নয়। প্রতিটি জাতিসত্তার মানুষকে সঠিক মর্যাদা না দিলে ভারতে যা ঘটেছিল, বাংলাদেশ কী ওই অমোঘ প্রক্রিয়া থেকে অব্যাহতি পাবে?
১৯২৮ সালে ভারতে হিন্দু মহাসভার জন্ম হলে জন্মক্ষণ থেকেই ওই সংগঠনটি প্রচার করতে থাকে, ‘ভারতবর্ষ হিন্দুদের জন্য। এটি তাদের পিতৃভূমি ও পবিত্র স্থান এবং এটি এমন দেশ যেখানে শুধু হিন্দুদের স্বার্থ সংরক্ষিত থাকবে। ভারতে শুধু একটি জাতি রয়েছে। তা হলো হিন্দু জাতি। মুসলমানরা একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং অখ- ভারতে ওইভাবেই তাদের অবস্থা চিহ্নিত হবে।’ (All India is Hindustan, the land of the Hindus, at once their fatherland and holy land, and the only land with which Hindus, unlike Moslems are concerned, the there is only one nation in India, the Hindu nation and that Moslems are only a minority community, and as such must take their place in a single India state.” K.K. Aziz, 1979, Delhi : ৮৬)।
১৯৩৬ সালের ২১ অক্টোবর লাহোরে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে ড. কুরক্রোটি (তিনি শঙ্করাচার্য নামে অধিক খ্যাত) বলেছিলেন, ‘আমি আবারও ঘোষণা করছি, হিন্দুস্থানে জাতীয় কুল, ধর্ম ও ভাষা হওয়া উচিত হিন্দুদের কুল, ধর্ম ও ভাষা’ (I affirm that in Hindustan the nation as race, religion and language ought to be that of the Hindus” -Ibid : ১২৩)। ১৯৩৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর কানপুরে অনুষ্ঠিত মহাসম্মেলনে সভাপতির ভাষণে সাভারকার (UD Savarkar) বলেন, ‘যে ভূমি সিন্ধু থেকে দক্ষিণে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত তা হলো হিন্দুস্থান। হিন্দুদের নিজস্ব ভূমি। হিন্দুরা যে জাতি গঠন করেছে তারাই এর মালিক। আমাদের কাছে হিন্দুস্থান ও ভারত সমার্থক। আমরা ভারতীয়। কেননা আমরা হিন্দু’। (শেষ)