
জুলিয়ান আসাঞ্জ আর উইকিলিকস বিশ্বব্যাপী মুখে মুখে উচ্চারিত দুটি নাম। আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধের সময়কার আড়াই লাখ গোপন কূটনৈতিক দলিল ফাঁস করার ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটিয়েছেন তিনি। তথ্য ফাঁসের দুনিয়া নাড়া দেয়া এমন সব ঘটনা নিয়ে ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকার দুই সাংবাদিক ডেভিড লেই এবং লু হার্ডিংয়ের বই গোপনীয়তার বিরুদ্ধে আসাঞ্জের যুদ্ধ। এ নিয়ে দেশকাল-এর ধারাবাহিক অনুবাদের ৯ম পর্ব। এবারের পর্বে উঠে এসেছে ব্র্যাডলি ম্যানিংয়ের কথা
(পূর্বের পর)
যেসব ঘটনা শেষ পর্যন্ত উইকিলিকসে বিরাট আকারের তথ্য ফাঁস করায় গড়িয়েছিল এর পেছনে ব্র্যাডলি ম্যানিংয়ে যৌনতার কী ভূমিকা ছিল তা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে তার গ্রেফতারের সময় থেকে। গ্রেফতার হওয়ার আগে হ্যাকার অ্যাড্রিয়ান লামোর সঙ্গে অনলাইন চ্যাটে ম্যানিংয়ের কয়েকটি মন্তব্যকে ভিত্তি করে কিছু ইঙ্গিত দিয়ে বলা হয় ম্যানিং নিজের লিঙ্গ পরিবর্তনের কথা ভাবছিলেন। ম্যানিং লামো-কে লিখেছিলেন, ‘সারা জীবন জেলে কাটাতে বা ফাঁসির দড়িতে ঝুলতেও রাজি আছে... ছেলে হিসেবে... যদি সারা দুনিয়ার প্রচার মাধ্যমে আমার ছবি প্রকাশের কোনো সম্ভাবনা না থাকে।’ আরেকবার লামো-র কাছে অভিযোগ করলেন তার সিপিইউ বা সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট ‘মাদার বোর্ডের জন্য তৈরি হয়নি’ বলে। কম্পিউটারের পরিভাষায় বিশ্লেষণ করে লেখা এ ভাষ্যটিকে অনেকে ব্যাখ্যা করেছেন, পুরুষের দেহ কাঠামোয় খাপ খাওয়াতে অক্ষম একটি মস্তিষ্কের যন্ত্রণায় বিদীর্ণ হওয়া নিয়ে একটি মানুষের অভিযোগ এটি।
এ ধরনের অনুমানগুলোর কোনো ভিত্তি বা প্রমাণ নেই এবং এমন আলোচনার প্রতিবাদ করেছেন অনেকে। তারা মনে করেন, ওই কথাবার্তার ভেতরে আসলে সামরিক বাহিনীতে সমকামীদের বিশ্বাসযোগ্যতাটি প্রশ্নবিদ্ধ করারই পরোক্ষ ইঙ্গিত রয়েছে। ম্যানিংয়ের যৌনতা আর রাষ্ট্রীয় গোপন বিষয় ফাঁস করার মধ্যে কোনো সম্পর্ক খুঁজে বের করাটি হেসে উড়িয়ে দেয়া ব্যক্তিদের একজন টিমোথি ওয়েবস্টার। মার্কিন সেনাবাহিনীর পাল্টা গোয়েন্দা কার্যক্রমের সাবেক স্পেশাল এজেন্ট ওয়েবস্টার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন ম্যানিং কাহিনীতে। ম্যানিং কম্পিউটার হ্যাকার লামোকে বিশ্বাস করে নিজের গোপন কথা বলেছিলেন। আর ম্যানিংকে কর্তৃপক্ষের কাছে লামো ধরিয়ে দেয়ার জন্য তথ্যদাতা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর লামোকে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ ঘটিয়ে দিতে মধ্যস্থতার কাজ করেছিলেন ওয়েবস্টার।
ওয়েবস্টারও সমকামী। তিনি বলেছেন, ‘টেলিভিশন আলোচনায় হাজির হওয়া আর সাক্ষাৎকার দেয়া সংখ্যায় অল্প। কিন্তু বোকার মতো বেশি কথা বলায় ওস্তাদরা সেনাবাহিনীতে কর্মরত সমকামীদের সততা-নিষ্ঠা-সম্মানবোধটি খাটো করায় সুবিধা নিতে ম্যানিংয়ের ঘটনা ব্যবহারের চেষ্টা করেছে। ম্যানিংয়ের তথ্য ফাঁসের ঘটনার সঙ্গে তার যৌনতার সম্পর্ক আছেÑ এমন ধারণা সম্পূর্ণভাবেই অবাস্তব ও হাস্যকর। হাজারো সমকামী ও উভকামী নারী-পুরুষ সম্মানের সঙ্গে সেনাবাহিনীতে কাজ করছে এবং নিজস্ব যৌনতার কারণে তারা আমাদের দেশরক্ষার কাজে কানো অর্থে কম কার্যকর হয়ে থাকেনÑ এমন কোন কিছু বলার চেষ্টা করা নিছক অর্বাচীন গোঁড়ামি ছাড়া কিছু নয়।’
অন্তত একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণে ম্যানিংয়ের যৌনতার প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। ‘জিজ্ঞাসা করো না, বলো না’ নীতির ব্যাপারে তার প্রতিক্রিয়া এবং তার বিরুদ্ধে ম্যানিংয়ের আধা প্রকাশ্য প্রচারণার মধ্যে নিহিত ছিল আগত ঘটনার সতর্ক সংকেত। সেনাবাহিনীতে কর্মরত অনেক সমকামীই নীরবে ভেতর থেকে ওই নীতি সংস্কারের চিন্তা করলেও তারা কোনো আদেশ অমান্য করার কথা ভাবতেন না। নিজের বিশ্বাসে ম্যানিং ছিলেন ভীষণভাবে দৃঢ়, অন্যায় বলে মনে হওয়া কোনো নিয়ম-কানুন মেনে নিতে একেবারে নারাজ। অনেকে বলতেন, ভীষণ রকমের মাথা গরম ছিল তার এসব বিষয়ে। ম্যানিংকে জেফ প্যাটারসন বর্ণনা করেছেন ‘সেনাবাহিনীর ভেতর কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে ম্যানিং শাস্তি এবং হেনস্তাও মেনে নিতে রাজি ছিলেন।’
তথ্য ফাঁস করার সঙ্গে ম্যানিংয়ের যৌনতার সম্পর্ক থাকার প্রাসঙ্গিকতা প্রমাণ করার আরেকটি ঘটনাও ছিল। এ ঘটনাটি ছিল ম্যানিংয়ের প্রথম সত্যিকার ছেলেবন্ধুর মাধ্যমে বোস্টনে সক্রিয় হ্যাকার জগতের সঙ্গে তার পরিচিতি হয়ে ওঠা। ওই ছেলেবন্ধুটি ছিলেন নিজের কেতায় গড়ে ওঠা বাজিয়ে, কণ্ঠশিল্পী ও মেয়েদের পোশাকে সেজে থাকা ‘রানী’ টাইলার ওয়াটকিন্স। তাদের পরিচয় হয়েছিল ২০০৮ সালের শরৎকালে। তখনো ম্যানিং ফোর্ট ড্রামের কর্মস্থলে থাকেন। নজরকাড়া জাঁকজমকে ভরা এবং বহির্মুখী চরিত্রের ওয়াটকিন্স ও চুপচাপ নিবিষ্ট ধরনের ম্যানিং মিলে অবধারিতভাবে একটি বিসদৃশ যুগল হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু ওই সময় ফেসবুকে লেখা ম্যানিংয়ের স্টেটাসগুলো দিয়ে বিচার করলে বোঝা যাবে, সৈনিকটি ‘রানী’র প্রতি গভীর প্রেমে পড়ে।
বোস্টন শহরের বাইরে অবস্থিত ব্র্যানডিস বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নায়ুবিজ্ঞান ও মনস্তত্ত্ব বিষয়ে পড়াশোনা করতেন ওয়াটকিন্স। ওয়াটকিন্স-এর সঙ্গে ম্যানিং দেখা করার জন্য নিয়মিতভাবে ফোর্ট ড্রাম থেকে ৩০০ মাইল পথ পাড়ি দিতেন। ওই নিয়মিত যাতায়াতের মাধ্যমে ব্র্যান্ডিস, বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে আসা ওয়াটকিন্সের অনেক বন্ধুর সঙ্গে ম্যানিং পরিচিত হয়ে ওঠেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচিতি ছিল কম্পিউটার নিয়ে মেতে থাকার জন্মস্থান হিসেবে যা ‘হ্যাকার সংস্কৃতির মেসোপটিমিয়া’ হিসেবে খ্যাতি কুড়িয়েছিল। ম্যানিংয়ের জন্য এসব বন্ধুর সঙ্গে পরিচিতি হয়ে ওঠা ছিল নতুনভাবে চিন্তা করার এক জগতে প্রবেশ করার মতো। এর সঙ্গে আকাশ-পাতাল তফাত ছিল তার ছেলেবেলার ছোট শহর ক্রিসেন্টের রক্ষণশীলতা ও ফোর্ট ড্রামের আঁটসাট, অনমনীয়, কঠোর সৈনিক জীবনের।
এখান থেকে পাওয়া যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ম্যানিং ক্রমেই আবিষ্কার করে চলেছিলেন তা ছিল বস্টন বিশ্বাবিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত ‘হ্যাকার স্পেস’। ছুটিতে আমেরিকায় ফিরে ওয়াটকিন্সের সঙ্গে দেখা করার সময় ২০১০ সালে বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে এলে ম্যানিং হ্যাকারদের ওই জগতের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠেন। বিল্ডস নামে পরিচিত কম্পিউটার প্রযুক্তির ওই সংঘটি অনেকখানি ছিল ষাটের দশকের শিল্পীদের গড়ে তোলা দলের মতো। বিল্ডসের সদস্যরা রেড রোবট মাউস তৈরি করা, খেলার মাঠে কোনো অ্যাথলিট কতো মাইল দৌড়ালেন এর হিসাব রাখার জন্য কম্পিউটার প্রোগ্রাম ডিজাইন করা, কম্পিউটার প্রযুক্তি দিয়ে কীভাবে দরজার তালা খোলা যায় (অবশ্যই নিজের ঘরেরটি) এর কেরামতি করার মতো নানান প্রকল্প নিয়ে কাজ করতে জড় হতো ওই গ্রুপে। এসব কাজ ছিল কিছুটা কম্পিউটার ও ইলেকট্রনিকস সম্পর্কিত কর্মশালা, ডু ইট ইওর সেলফ বা ‘নিজে করে দেখো’ ধরনের হাতে-কলমে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্লিনিকের কাজ। নানান কাজ ও চিন্তা নিয়ে সক্রিয় ওই কর্মীদের এক জায়গায় মিলিত হওয়ার পেছনে ছিল হ্যাকার সংস্কৃতি নিয়ে সবার মধ্যে থাকা সাধারণ আদর্শ।
বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ডেভিড হাউস যিনি সেখানে হ্যাকার স্পেস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন- তিনি বলেন, সাধারণত যা ভাবা হয়, হ্যাকিং মাথার খুলি এবং আড়াআড়ি হাড়ের চিহ্নওয়ালা কোনো অপরাধী দলের বেআইনি যেনতেন কোনো কাজ নয়। বরং, এটি পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখার একটি পথ।