
শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা নিয়ে জটিলতা কাটছে না। প্রথম শ্রেণিতে পরীক্ষাবিহীন ও লটারির মাধ্যমে ভর্তির নিয়ম করা হলেও অধিকাংশ বিদ্যালয়ে প্রাকপ্রাথমিক স্তরেই শিশুদের ভর্তি করানো হয়। প্রাকপ্রাথমিকের ওই শিক্ষার্থীরাই উত্তীর্ণ হয়ে লটারি ছাড়া প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। ফলে অনেক ছাত্রছাত্রী নিজ এলাকার বিদ্যালয়গুলোয় সরাসরি প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারছে না। সম্প্রতি সরকার প্রাথমিক ভর্তিতে ৪০ শতাংশ ‘এলাকা কোটা’ সংরক্ষণের নির্দেশনা দিলেও পরিস্থিতির উন্নতি হবে না বলে জানান রাজধানীর একাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকরা।
শিক্ষক-অভিভাবকরা জানান, বিদ্যালয়গুলোয় কোন শ্রেণি থেকে শিক্ষার্থী পড়ানো হবে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বিধান নেই। কিছু সংখ্যক বিদ্যালয় প্লে নামে একটি শ্রেণি চালু রেখেছে। সাধারণত শিশুর তিন বছর বয়স থেকে ওই শ্রেণির লেখাপড়া শুরু হয়। আবার কোথাও জুনিয়র ওয়ান বা প্রাকপ্রাথমিক কিংবা ছোট ওয়ান নামে একটি শ্রেণি আছে। এই শ্রেণিতে পাঠদান শুরু করা হয় প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির এক বছর আগে। আবার অনেক স্কুলে প্রথম শ্রেণি থেকে লেখাপড়া শুরু হয়। শিশুর শিক্ষা জীবন শুরুর এ পার্থক্যের কারণে যারা তাকে প্রথম শ্রেণি থেকে পড়াতে চান তারা সন্তান ভর্তি করতে গিয়ে দুর্ভোগ ও জটিলতায় পড়ছেন।
এদিকে বিদ্যমান এ জটিলতার অবসান না ঘটিয়েই প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রতিটি বিদ্যালয়ের জন্য ৪০ শতাংশ এলাকা কোটা প্রবর্তন করেছে সরকার। গত ২৬ অক্টোবর শিক্ষা মন্ত্রণালয় বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা দেয়। সরকারি বিদ্যালয়গুলোকেও একই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি বিদ্যালয়কে প্রথম শ্রেণির মোট আসন সংখ্যার ৪০ শতাংশ বিদ্যালয়টির অবস্থানগত এলাকার শিশুদের ভর্তির মাধ্যমে পূরণ করতে হবে। কিন্তু অনেক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির আসনই নেই। প্রাকপ্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের দিয়েই অধিকাংশ আসন পূরণ হয়ে যায়। আবার রাজধানীতে একই এলাকায় একাধিক বিদ্যালয় থাকলেও শিক্ষাদানের মান সমান না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের ভর্তি করানো নিয়ে দুশ্চিন্তা ও সংশয়ে পড়েছেন অভিভাবকরা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা শহরে প্রায় ৪০ হাজার কিন্ডারগার্টেন ও ইংরেজি মাধ্যম স্কুল রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ৩ থেকে ৪ বছর বয়সের শিশুকে প্লে শ্রেণিতে ভর্তি নেয়া হয়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৩০৮টি। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রাকপ্রাথমিক বা ছোট ওয়ান থেকে ভর্তির সুযোগ রয়েছে। তবে ঢাকায় প্রাথমিক স্তরের ক্ষেত্রে হাই স্কুল সংলগ্ন প্রতিষ্ঠানগুলো অভিভাবকদের কাছে বেশি জনপ্রিয়। এ কারণে ৩১টি সরকারি হাই স্কুল ও অর্ধশতাধিক নামকরা বেসরকারি হাই স্কুলে ভর্তি মৌসুমে হুমড়ি খেয়ে পড়েন ভর্তিচ্ছু ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকরা। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)-র তথ্য অনুযায়ী সরকারি হাই স্কুলের মধ্যে মাত্র ১৩টিতে প্রথম শ্রেণি রয়েছে। সরকারি এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রতি বছর ঢাকায় গড়ে ২ লাখ শিশু প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। কিন্তু মাত্র ৪০-৪৫ হাজার শিশু পছন্দের বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারছে।
ভর্তি নিয়ে জটিলতা প্রসঙ্গে রাজধানীর স্কুল শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সংগঠন ‘অভিভাবক ফোরাম’-এর চেয়ারম্যান জিয়াউল কবীর দুলু বলেন, রাজধানীর সব বিদ্যালয়ে শিশুর শিক্ষা জীবন শুরুর ধারা এক রকম নয়। একেক স্কুলে একেক শ্রেণি বা ধাপে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়। এই ভিন্নতার কারণে শিশুর ভর্তি নিয়ে সংকটে পড়তে হয়। তিনি বলেন, এই ভিন্নতা রাখা হয়েছে মূলত বিদ্যালয়ের এক শ্রেণির শিক্ষক ও গভর্নিং বডির সদস্যদের শিক্ষা ব্যবসা করার জন্য। অনেকে ভর্তি বাণিজ্য করার জন্য প্রথম শ্রেণিতে যে সংখ্যক আসন থাকে এর সব খালি ঘোষণা করে না। প্রকাশ্যে কিছু আসনে ভর্তি নেয়। বাকিগুলোয় অর্থের বিনিময়ে ভর্তি করে। এ বাণিজ্য দূর করা এবং একই শ্রেণি থেকে পড়ালেখা শুরুর ব্যবস্থা করা উচিত সরকারের।
এদিকে বিদ্যালয়ে ভর্তির কোটায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। অভিভাবকদের একটি অংশ বলছে, নিজ এলাকায় ভালো বিদ্যালয় না থাকায় তারা অন্যত্র শিশুকে পাঠাচ্ছেন। কিন্তু এলাকার স্কুলে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই নিজের সন্তানকে পড়ালে বিদ্যালয়ের মান উন্নত হবে। তবে অভিভাবকদের অপর একটি অংশ বলছে, সিদ্ধান্তটি ভালো হলেও এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সময় উপযোগী নয়। আগে এলাকাভিত্তিক বিদ্যালয়গুলোর মান ন্যূনতম মানদ-ে পৌঁছানো প্রয়োজন। এলাকাভেদে বিদ্যালয়ের মান ভালো না করে এভাবে নিয়ম তৈরি করা ‘ঘোড়ার আগে গাড়ি বাঁধা’র সমান।
এ প্রসঙ্গে মাউশি-র মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন বলেন, বিদ্যালয়ে এলাকাভিত্তিক আসন সংখ্যা নির্ধারণ অনেক দিনের দাবি। শিক্ষার মান বৃদ্ধির পাশাপাশি যানজট নিরসনেও এ সিদ্ধান্ত ভূমিকা রাখবে। এ জন্য রাজধানীকে জনসংখ্যার ভিত্তিতে ১৬টি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি অঞ্চলের শিশু তার এলাকার বিদ্যালয়ে ভর্তিতে অগ্রাধিকার পাবে। তিনি বলেন, বছরের শুরুতে সারা দেশে সর্বোচ্চ ১০০ বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে ভর্তির জোর কার্যক্রম চলে। বাকিগুলোয় শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের তেমন আকর্ষণ থাকে না। সেগুলোর মান ভালো না হওয়ার নানান কারণের একটি হলো এতে স্থানীয় প্রভাবশালীদের নজর না দেয়া। যদি তারা নিজ এলাকায় সন্তানকে ভর্তি করান তাহলে নজর দেবেন। এভাবে সব বিদ্যালয়ের মান উন্নত হবে। আমরাও সব বিদ্যালয়ে সমান নজর দিচ্ছি।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আলমগীর বলেন, একটি স্কুলের আশপাশের ২ কিলোমিটার এলাকাকে ক্যাচমেন্ট এরিয়া ধরে এ প্রথা। গত ৮ অক্টোবর আমরা একটি নির্দেশনা জারি করেছি। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী ক্যাচমেন্ট এলাকার শিশু আগে ভর্তি হবে। এরপর বিদ্যালয়ে আসন খালি থাকলে এতে ক্যাচমেন্ট এরিয়ার বাইরের শিশু ভর্তি হবে। মূল নীতি হলো, শিশু তার কাছের বিদ্যালয়ে ভর্তিতে অগ্রাধিকার পাবে।