‘নন্দিত নরকে’ হুমায়ুন আহমেদের জন্মদিন
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১২ নভেম্বর ২০১৫
শামসেত তাবরেজী

যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের নতুন এক অস্বস্তির কালে হুমায়ুন আহমেদ অনেকটা এক হাত দেখিয়ে স্রেফ গল্প লিখে বাংলাদেশের পাঠককে প্রায় এক কাতারে দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘নাও, পড়ো’। আমার ধারণা হয়েছিল, তার কলমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশে আরও কিছু ঝরনা কলম প্রায়-বইবিমুখ তরুণপ্রজন্মকে গল্পের রাজ্যে নিয়ে আসবেন। আমি যতটা আশা করেছিলাম, ততটা পূরণ হয় নাই। যা হয়েছে, তার জন্যও গর্ব করি বৈকি। তা যদি আমাদের ‘হয়ে-উঠি-উঠি-সমালোচনা-সাহিত্য’ একটু খোলাসা করে দিতেন, তাহলে বুঝা যেত, হুমায়ুনের সঙ্গে বাকীদের ফারাকটা কোথায়?
পয়লাই বলতে হবে ভাষায়। তাঁর ছিল অনায়াস সহজ করে বলার এক ভঙ্গি। খাঁটি গল্প বলিয়ে যেভাবে বলেন। তাঁর গদ্য এমনই প্রবহমান যে সত্য-মিথ্যা কোন কিছুই পাঠককে থামিয়ে দেয় না। যা তিনি ভেবেছেন, অক্ষর-প্রতীকে তাই-ই তর্জমা করে প্রকাশ করতে পেরেছেন। স্বাধীন একটি দেশে লেখার এই গুণটি আমার কাছে খুব ইম্পর্ট্যান্ট মনে হয়েছিল। আমি যখন গুম্ফবান হয়েছি, একবার/দুবার এমনও মনে হয়েছিল বাংলাদেশের সংবিধানটি কি এমনই সহজ অনায়াস ভাষায় হত পারত না?
আরেকটি কথা বলা বাড়তি হবে না যে হুমায়ুন আহমেদ এই ভাষাটিকে আপনা-আপনি বা স্বপ্নযোগেও পান নি, বরং এর জন্য তাঁকে বেশ খাটাখাটনি যে করতে হয়েছে, বোঝা যায়। আমি যতটুকু উপলব্ধি করতে পারি, ভাষা সহজ ও স্রোতস্বিনীর মত হয়ে ওঠে ভাষাকে ব্যক্তিগত সম্মতি না মনে করলে। ভাষা লোকের, লোকোত্তরের, সমাজের, আপামরের। এই বিশ্বাস বা ভালবাসা লেখককে এক বিঘত হলেও এগিয়ে রাখে বৈকি।
আগামীকাল হুমায়ুন আহমেদের ৬৭ তম জন্মদিন। তথাকথিত সভ্য-দুনিয়ার মানুষের মজার দিকটা হল, মরে গেলেও এদের অনেকের বয়স বাড়তে থাকে। মৃতের বয়োঃবৃদ্ধি সত্যিই মজার! যাহোক, ‘বিখ্যাত’ মানুষের এই মরণোত্তর বেঁচে থাকাকে আমরা আহ্লাদ করে বলি, ‘অমরত্ব’। ব্যক্তিমানুষের কৃতি এমন কিছু রেখে যায় যা কয়েক প্রজন্ম ধরে আনন্দ-বেদনার খোরাক হয়ে থাকে। পুরানাযূগের কাছে নতুনযূগের মানুষের এই চাওয়ার ভেতর দিয়ে আরও-আরও নতুনযূগের মানুষের খোরাক পৌঁছে দেওয়ারই আরেক নাম ‘ইতিহাস’। তত্ত্বের দিক থেকে ‘আমাকৃত’ ইতিহাসের এই সংজ্ঞা গ্রহণ না করাই ভাল। তবু কথার কথা হিশাবে মেলে নিলে ক্ষতি কি। তাই, সিধা কথার জোরে বলাই যায়, হুমায়ুন আহমেদ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের ‘বিশেষ’ অংশ, একটু অমরতো বটেই, নইলে, আমরা যখন নিত্য দিনের খুনখারাবি পর্যন্ত একদিন পরই ভুলে যাই, তখনও হুমায়ুন আহমেদের নিয়মিত জন্মদিন পালন করে যাচ্ছি কেন। এ হল, ব্যক্তির প্রতিষ্ঠান হয়ে-ওঠা, তার ছাঁদছিরি যেমনই হোক।
শুদ্ধমাত্র ‘কেতাব’ লিখে এই ‘অর্জন’ বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে খুব সহজ কথা নয়। যারা সাহিত্য করেন, এ জন্য তাঁরা একটু শ্লাঘা অনুভব করতেই পারেন। অবশ্য হুমায়ুন আহমেদ শুধু গল্প-উপন্যাসই লেখেন নাই। টেলিভিশনের নাটক থেকে সিনেমা, গান, কত কিছুই না করেছেন। পরে ভুলে যেতে পারি, তাই আগে-ভাগেই একটা ব্যক্তিগত মত বলি, হুমায়ুন গান জিনিশটাও ভাল বুঝতেন। কেন যেন মনে হয়, নাটক-সিনেমার যে কসরত তিনি করেছিলেন, গানের সঙ্গে থাকলে আরও ভাল হত কিনা তা আল্লাহই ভাল জানেন।
হুমায়ুন আহমেদ ছিলেন রসায়ন শাস্ত্রের মানুষ। আমার অকাল-প্রয়াত মেজোভাই ছিলেন তাঁর এক-দুই ক্লাস নীচের ছাত্র এবং হুমায়ুন আহমেদ ঐ বিভাগের নবীন শিক্ষক। ভাইয়ের বরাতে হুমায়ুন আহমেদের সঙ্গে কার্জন হলের লাল ইমারত ঘেরা সবুজ মাঠে আমার পরিচয় হয়। কৌতুকপূর্ণ চেহারা, বেঁটেমতো, কিন্তু ভীষন বুদ্ধিদীপ্ত। ইতিমধ্যে আমি তাঁর দুইখানা বই মগজস্থ করে ফেলেছি। একটা, প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’, আরেকটা ছোটদের বিজ্ঞানোপন্যাস ‘তোমাদের জন্য ভালবাসা’। দুটি বইই আমি ঘোরের মত পড়ে ফেলি। একরাতের মধ্যে নন্দিত নরকের ‘রাবেয়া’ চরিত্রটি আমাকে দখল করে নেয়। রাবেয়ার জন্য তাঁর ভাই যেমন বিক্ষুব্ধ হয়ে ‘মামাকে’ কুপিয়ে মেরে প্রতিশোধ নেয়, আমার মধ্যেও যেন সেই একই রকম প্রতিশোধ স্পৃহার জন্ম হয়। ভাগ্যিস, আমাকে ঐরকম কোন বীভৎস ঘটনার মুখোমুখি হতে হয় নাই। কিন্ত্র একটা বানানো গল্প বা উপন্যাস একটি কিশোর মনকে যেভাবে বিক্ষুব্ধ করে তুলতে পেরেছিল, তাতে ঐ গল্পটি আর বানানো না থেকে বাস্তবের চেয়েও বেশি উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। সমাজের তলায়-তলায় যে সত্য থাকে, তার এক সত্য হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসকে এক লহমায় বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে দিয়েছিল। হুমায়ুন আহমেদকে এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয় নাই। কিন্তু শুদ্ধমাত্র সত্যের খাতিরে নয়, বলা উচিৎ-ই, তা হল, হুমায়ুন আহমেদ যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সেই ছুটে-আসা পাঠকের দিকে লেখকসম্মত সততা দিয়ে মনোযোগ দেন নাই। ততদিনে, বাংলাদেশে পণ্যোদ্গমের ঝলমলানি শুরু হয়ে গেছে। উনিও সেদিকেই গেলেন।
শুনেছি, তাঁর বন্ধু ও বড়ভাইতূল্য লেখক আহমদ ছফা হুমায়ুন আহমদকে অতি-লেখার ব্যাপারে কিঞ্চিৎ সাবধানও নাকি করেছিলেন। নন্দিত নরকে বা আরও দুচারটি বইয়ের পর থেকে হুমায়ুন আহমেদ তাঁর পাহাড়তূল্য প্রতিভাকে নিছকই ইয়ার্কি মেরে ধ্বংস করলেন।
হুমায়ুন আহমেদ তখনও প্রায় একমাত্র জনপ্রিয় লেখক বাংলাদেশে, কিন্তু যথেষ্টই আবিল হয়ে পড়েছেন। কেন? ছোট পরিসরে শুধু এইটুকু বলব, হুমায়ুন আহমেদ ছিলেন, যাকে আমরা বলি স্বাধীনতাব্যবসায়ী বা লিবারেল কি নিউ লিবারেল, ইনাদের কাছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এমনকি মুক্তিযুদ্ধ একটি উদ্যাপন মাত্র। যুদ্ধ, স্বাধীনতা ইত্যাদিকে ধ্রুবক বিষয় মনে করে তাঁকে মহীয়ান করে তোলাই সাহিত্যের একমাত্র কাজ মনে করেন। ইনারা মনে করেন, ইতিহাসের সব ঘটনাই ঘটে গেছে, সমাজের মধ্যেও রূপান্তরের প্রক্রিয়া শেষ। এখন সাহিত্যের কাজ হল সেই ‘ইভেন্ট’গুলোকে গৌরবান্বিত করা। দার্শনিক ও নন্দতাত্বিক স্ভেটান তদোরভ আমাদের জানান, ঠিক এই জায়গা থেকে ফাসিস্ট সাহিত্যের শুরু হতে পারে। মেদ্দা কথা, ইতিহাসকে অতীত থেকে না দেখে বর্তমানকাল থেকে দেখাটা জরুরী। তা নাহলে সমাজের ভিতর রূপান্তরের গোপন টানাপোড়েনগুলো প্রকাশ হতে পারে না। লেখকের কাজ তো এইটুকুই। তারপরও যে ভাষাটা তিনি নিয়ে এলেন, তা নিয়ে আমরা খুব কিছু ভাবলাম না। উত্তরসুরী গল্পলেখকরাও গল্পগাছায় হুমায়ুনের স্টাইলের ভাষার-লোকভিত্তিটা বুঝে উঠতে পারলেন না। তাঁরা গেলেন ‘নিরীক্ষার’ দিকে। নিরীক্ষা মন্দ জিনিশ না, কিন্তু লেখকরা যেহেতু ভাষাই লেখেন শেষ পর্যন্ত, তাই হুমায়ুনের ভাষাটাকে নিয়ে কি করা যায় একটু ভাবতে পারতেন। গল্পের দেশ বাংলাদেশে যে গল্প-উপন্যাস খুব যুতসই হল না, এটা তার অন্তত একটা কারণ হতে পারে। যদিও কখনও কখনও তাঁদের মৃদু ফিসফাস শুনি, বই জিনিশটাই টিকে থাকবে তো?
ছোট্ট একটা কথা দিয়েই আজকের লেখার ইতি টানব।
আমার মনে হয়েছে, হুমায়ুন যতদিন শক্তিশালী ছিলেন, তিনি সাহেবদের মতে যাকে বাস্তববাদী গল্পকার বলা হয়, তা ছিলেন না। পরবর্তী লেখকরা গল্পকে তথাকথিত (কঠিন!) বাস্তববাদের ধোঁয়াশার মধ্যে নিয়ে গেলে, হুমায়ুনকৃত সেই পাঠক আবারও গল্প-পড়া ছেড়ে দেয়। আমার ধারণা, বাস্তববাদী সাহিত্য সত্যকে কিঞ্চিৎ আড়াল করে রাখে। যাহোক, আমাদের বাস্তব ততদিনে উদ্ভট হতে শুরু করেছে। তবে, দুঃখের মধ্যে শুধু এইটুকু সত্যি, গল্প এখন লেখা হয় না, গল্প নিত্যদিন ঘটে, নিত্যদিন ‘নন্দিত নরকে’ হয়ে ওঠে।
কবে আমাদের সত্যের গল্প লেখা হবে?