হুমায়ূন সংখ্যা

হুমায়ূন আহমেদ ও একটি লাল অথবা সাদা ব্লাউজ

প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১২ নভেম্বর ২০১৫

মাইনুল এইচ সিরাজী

হুমায়ূন স্যারের ক্লাসে বসে আছি। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছি তার লেকচার। ক্লাস শেষে স্যার বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। চিৎকার দিয়ে বললাম, স্যার, একটা কথা ছিল। স্যার থমকে দাঁড়ালেন। একটা খাতা বের করে বললাম, একটি গল্প লিখেছি- যদি একটু দেখে দিতেন। অল্পতেই রেগে যেতেন স্যার। বললেন, ‘গাধা কোথাকার। তুমি কি ভেবেছ এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোমার গল্প পড়বো?’ তারপর ছোঁ মেরে খাতাটা নিয়ে বললেন, ‘আমার চেম্বারে এসো।’
হুমায়ূন স্যারের চেম্বারে গেলাম। স্যার প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কি আমার ছাত্র?’ বললাম, না স্যার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি বাংলা বিভাগে। স্যার বললেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আমার বিশেষ পছন্দ। ওখানে পাহাড়-পর্বত আছে। আমি ওখানে যোগ দিতে চাই। তুমি একটু খোঁজখবর দিও।’ বললাম, জি, আচ্ছা।
স্যার গল্পটি পড়া শুরু করলেন। আমি দাঁড়িয়ে আছি। স্যারের সামনে অনেক খালি চেয়ার। আমি কি একটিতে বসবো? বললাম, বসতে পারি স্যার? স্যার বললেন, ‘না পারো না। দাঁড়িয়ে থাকো।’
পুরো গল্পটি পড়ে স্যার বললেন, ‘তোমার গল্প অতি চমৎকার হয়েছে। কিন্তু একটা সমস্যা আছে।’ বললাম, কী সমস্যা? স্যার গল্প থেকে পড়তে লাগলেনÑ ‘অল্প বয়সী মেয়েটিকে শাড়িতে দারুণ  লাগছিল। কিন্তু সে শাড়ি সামলাতে পারছিল না। পিঠের অংশটা পুরোটাই খালি। আর এতে আঁটসাঁট লাল ব্লাউজের নিচ থেকে গোলাপি অন্তর্বাস মারাত্মকভাবে ফুটে উঠছিল ...।’ স্যার বললেন, ‘লালের নিচে গোলাপি এভাবে ফুটে ওঠার কথা নয়। তুমি ব্লাউজটাকে সাদা বানিয়ে দাও।’  বললাম, জি, আচ্ছা। স্যার ড্রয়ার থেকে ক্যাপস্টেন সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটি ধরালেন। আমার দিকে একটি বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘খাও।’ বললাম, কী করছেন স্যার? স্যার বললেন, ‘সমস্যা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সব করতে পারে। খাও। জোরে টান মারো।’ স্যারের পাগলামির কথা অনেক শুনেছি। সেদিন সরাসরি প্রত্যক্ষ করলাম। স্যারের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা গোটা সিগারেট খেতে হয়েছে আমাকে।
এরপর থেকে ঢাকা গেলেই স্যারের বাসায় যেতাম। স্যারের দরজা আমার জন্য সব সময় খোলা থাকতো। ব্যক্তিগত, পারিবারিক কথাবার্তা স্যার আমার সঙ্গে শেয়ার করতেন। ছোট ভাই আহসান হাবীবকে নিয়ে হতাশা প্রকাশ করতেন প্রায়ই। বলতেন, “ওর মেধা আছে। কিন্তু কাজে লাগাতে পারছে না। ‘উন্মাদ’ নিয়ে পড়ে আছে। উন্মাদ তো কেউ পড়ে না। মফস্বলে যে পত্রিকা পাওয়া যায় না তা আবার পত্রিকা হলো নাকি? আর জাফর কী করছে দেখো। সে মনে হয় একাই দেশটাকে শুদ্ধ করে ফেলবে। আমি তাকে বলেছি, তুই এটা পারবি না। বরং আরো নিঃসঙ্গ হয়ে পড়বি। আমার কথাটা বোধহয় ওর পছন্দ হয়নি। তবে ‘নিঃসঙ্গ’ শব্দটা তার পছন্দ হয়েছে। এরপর থেকে সে ভোরের কাগজে ‘নিঃসঙ্গ বচন’ নামে কলাম লিখতে শুরু করলো।”
হুমায়ূন আহমেদ আমাকে একদিন হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার নাম সিরাজী কেন? তুমি ইসমাইল হোসেন সিরাজীর আত্মীয়স্বজন নাকি?’ বললাম, না স্যার। সিরাজী আমার বাবার উপাধি। সিরিজের ভক্ত ছিলেন বাবা মাসুদ রানা। মাসুদ রানার একটা চরিত্র আছে সিরাজী। বাবা ওই নামটা নিজের নামের শেষে লাগিয়ে নিয়েছেন। স্যার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘আপনার বাবা কতো ভাগ্যবান।’ আমি তো অবাক। স্যার আমাকে ‘আপনি’ বলছেন কেন? স্যার বললেন, “আমি এই মুহূর্তে আপনাকে আশ্রয় ভাবছি, অবলম্বন ভাবছি। তাই ‘আপনি’ বলছি। আপনার বাবার উপাধি লাগিয়ে আপনি গর্বিত। আর আমার ছেলেমেয়েরা নামের শেষে আহমেদ উপাধিটা এখন আর লাগায় না। আমার মতো খারাপ বাবা এ পৃথিবীতে আর একটাও নেই।” বললাম, আপনি শাওনকে বিয়ে করতে গেলেন কেন? স্যার বললেন, ‘প্রেম মানে না জাত, মানে না রাত। এটা কার কথা জানি না। এর চেয়ে বড় সত্য আর নেই। আর প্রেম একটা শরমের বিষয়। তাই এটা নিয়ে আর কিছু জানতে চেয়ো না।’
ক্যানসারের চিকিৎসা চলাকালে স্যার যখন দেশে এসেছিলেন তখনো তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। স্যার আমাকে নুহাশ পল্লীতে নিয়ে গিয়েছিলেন। ঘুরে ঘুরে গাছ চিনিয়েছেন। দীঘি লীলাবতীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আমাকে বললেন, ‘নুহাশ পল্লীতে একটা কাউ গাছ লাগাতে হবে। কাউফল। আমি ওই গাছটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। সেদিন একটি দৈনিক পত্রিকায় মোকাররম হোসেনের একটা লেখা দেখলাম গাছটা নিয়ে। তুমি একটু মোকাররম হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করো তো। আমার একটা গাছ দরকার।’ বললাম, কারো সঙ্গে যোগাযোগের দরকার নেই স্যার। এবার ঈদে বাড়ি গেলে আপনার জন্য ১০টি চারা নিয়ে আসবো। আমাদের নোয়াখালীতে কাউ গাছের অভাব নেই। স্যার বললেন, ‘১০টি দিয়ে আমি কী করবো? একটি আনলেই চলবে।’
হায়! হুমায়ূন আহমেদকে কাউ গাছের চারাটা আর দেয়া হবে না।
[হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর তার কড়া সমালোচকরাও প্রশংসা করতে শুরু করেছেন এবং হুমায়ূনের সঙ্গে কখন কী কথা হয়েছে, কোথায় দেখা হয়েছে ওই বিবরণ দিচ্ছেন। ওইসব বিবরণের সত্যাসত্য জানি না। তবে আমার এই স্মৃতিচারণ সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh