হুমায়ূন সংখ্যা

জীবনের সহজ পাঠ হুমায়ূন পাঠ

প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১২ নভেম্বর ২০১৫

রাব্বী আহমেদ

মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের ছোট ছোট দুঃখ, বেদনা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আশা-হতাশাময় আটপৌরে জীবনের রূপকার হুমায়ূন আহমেদ। স্বাধীনতা-পরবর্তী অস্থিতিশীল এলোমেলো সময়ে তার লেখা শীতল বাতাসের মতোই নাড়িয়ে গেছে সাহিত্যপিপাসু, বইপড়ুয়া অগণিত মানুষকে। সহজ বাক্য, অনাড়ম্বর বর্ণনা ও নিজস্ব স্টাইল তাকে এনে দিয়েছে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখকের সম্মান। আমাদের চারপাশের নিত্য ঘটে যাওয়া টুকরো টুকরো ঘটনা তিনি মিহি সুতার কারুকার্যে একই সঙ্গে সেলাই করেছেন অপরূপ নকশিকাঁথায়। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলোই উঠে এসেছে তার লেখায়। এক মধ্যবিত্ত তরুণ যার পিতা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ। অর্থকষ্ট, দারিদ্র্য ও  জীবনের সীমাহীন ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে তিনি তার চরিত্রগুলোকে করেছেন নিজের জীবনের প্রতিচ্ছবি। হিমু চরিত্রের মধ্যে দেখা মেলে এক এলেবেলে বেকার তরুণের যে হলুদ রঙের পাঞ্জাবি পরে ঘুরে বেড়ায়। তার কথাবার্তা অসংলগ্ন মনে হলেও এটিও মিথ্যা নয় যে, প্রতিটি তরুণের ভেতরেই এক হিমুর বসবাস, পারিপার্শ্বিক চাপ কিংবা সামাজিকতার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে সে চরিত্রকে চেপে রেখেই প্রত্যহ অভিনয় করে যেতে হয়। এই স্বাধীনচেতা হিমু চরিত্র তরুণদের অবচেতন অবস্থার বহিঃপ্রকাশ যেন। যার জন্য অপেক্ষায় থাকে রূপা নামে এক তরুণী। কিন্তু হিমু কখনো রূপার কথা রাখে না। এই কথা না রাখার মধ্যেও এক ধরনের হেয়ালিপনা, এক ধরনের মেগালোমেনিয়াক পারসোনালিটি কাজ করে। যে তরুণ তার স্বভাবসুলভ চরিত্র দ্বারা কখনো র‌্যাব, কখনো পুলিশ, কখনো মাজারের পীর, কখনো রাষ্ট্রের বড় কর্তার সঙ্গে বিচিত্র কথোপকথন দ্বারা বিভিন্ন অসঙ্গতিকে তুলে ধরে। বার বার প্রশ্নবিদ্ধ করে আমাদের তথাকথিত সমাজ ব্যবস্থাকে। তাই হলুদ পাঞ্জাবি পরা হিমু চরিত্র শুধু একটি চরিত্রই নয়, প্রতিটি তরুণের ভেতর লালন করা একটা আলাদা সত্তা যাকে আড়াল করে অভিনয় করে যেতে হয় তথাকথিত সামাজিকতার। এক্ষেত্রে আমাদের মনে পড়ে ওই বিখ্যাত প্রবাদÑ ‘মানুষ মুক্ত হয়ে জন্মালেও সে আসলে আজন্ম শৃঙ্খলে বন্দি।’ তাই হিমু স্বভাবে বাউ-ুলে অথচ গভীর জীবনবোধসম্পন্ন এক তরুণ যে ওই শৃঙ্খল ভেঙে জ্যোৎস্না রাতে খালি পায়ে বেরিয়ে পড়ে ‘যে জীবন ফড়িংয়ের, দোয়েলের’ তার সঙ্গে দেখা হবে বলে।
হুমায়ূন পাঠ করতে গিয়ে এক তরুণ সহজেই লেখার ভেতরে ঢুকে যেতে পারে। তাই যেন নিজস্ব জীবন আখ্যানই রচিত হয়েছে এই ভেবে, তরুণ পাঠক এক তীব্র আকর্ষণ নিয়ে এগিয়ে যাবে সামনে। বিষয়বস্তুর দিক থেকে হুমায়ূন আহমেদের গল্প কিংবা কাহিনী হালকা মনে হতে পারে। কিন্তু এও মিথ্যা নয় যে, অহরহ ঘটে যাওয়া দৈনন্দিন ঘটনার ভেতরেই লুকিয়ে থাকে আনন্দ-বেদনার সাতকাহন। ফলে কোনো তরুণ কিংবা তরুণীর জীবনে হুুমায়ূন আহমেদ জড়িয়ে থাকেন নিবিড়ভাবে। চাকরি না পাওয়া বেকার তরুণের যন্ত্রণা, মধ্যবিত্তের চিরায়ত অভাব-অনটন, নাগরিক জীবনের বিচ্ছিন্নতা বোধ, সংকট কিংবা নীল তোয়ালেতে মুখ লুকিয়ে অভিমানী তরুণীর কান্না, বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাওয়া তরুণীর সামাজিক দুরবস্থা, পিতার চিন্তাযুক্ত মুখ আবার কদম ফুল হাতে নিয়ে  নীল শাড়ি পরা কোনো রূপসীর দাঁড়িয়ে থাকা, প্রেমিক পুরুষের ভেতরে জন্ম নেয়া ভালোবাসার অনুভূতিÑ সবকিছুই যেন একাকার হয়ে মিলিয়ে যায় তার লেখায়। এ কারণে হুমায়ূন আহমেদ প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকেন গৃহত্যাগী জ্যোৎস্না কিংবা শ্রাবণসিক্ত কোনো বর্ষাবেলায়। তিনি একটি বিশাল প্রজন্মকে বই পড়া শিখিয়েছেন। শিখিয়েছেন জ্যোৎস্না ও বৃষ্টিতে ভিজতে। এখানেই তার সবচেয়ে বড় সার্থকতা। বাংলাদেশে পাঠক সৃষ্টিতে তার সমকক্ষ কেউ নেই। বইবিমুখ একটি সুবিশাল প্রজন্মকে বইমুখী করা তার অনন্য সাফল্য।  
হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমণি’ মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য দলিল। এটি বাংলা চলচ্চিত্রে এক অনবদ্য সৃষ্টি। এছাড়া তিনি বেশকিছু মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক লেখা লিখেছেন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ তার লেখায় গভীরভাবে প্রথিত ছিল। ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ উপন্যাসটিতে তিনি বিভিন্ন চরিত্রের চোখে বিভিন্ন আঙ্গিকে মুক্তিযুদ্ধ দেখিয়েছেন। ফলে কোনো পাঠক বিভিন্ন দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ দেখার প্রয়াস পাবেন।
ছোটগল্প ও সায়েন্স ফিকশন রচনার ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদ প্রচলিত প্রথার ভেতরে নিজেকে আটকে রাখেননি। তাই তার সায়েন্স ফিকশনগুলোয় জাগতিক সময়ের ভেতরে থেকেই মহাজাগতিক অবস্থার বর্ণনা পাওয়া যায়। এছাড়া ছোটগল্পগুলো আকারে ছোট হলেও গভীরতা বয়ে বেড়ায়।
হুমায়ূন আহমেদের তৈরি করা চরিত্রগুলো প্রত্যেকেই তার জায়গায় অনন্য। মিসির আলী চরিত্রের রহস্যময়তা, যুক্তিতর্ক উপস্থাপন, তার বিভিন্ন ঘটনার ব্যাখা পাঠকের মনে দারুণ এক ভাবালুতার জন্ম দেয়। ঠিক এর বিপরীতেই হিমু চরিত্র  মানুষের মনের খেয়ালি জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। দুটি বিপরীতমুখী চরিত্রকে তৈরি ও উপস্থাপন একজন লেখকের ক্ষেত্রে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ। তিনি ওই কাজটিই নিপুণভাবে করেছেন। মানব মনের এই দ্বান্দ্বিক ঐক্যকে দুটি ভিন্ন চরিত্র দ্বারা রূপায়ণ করে একই সঙ্গে মানুষের জীবনের দুটি বিচিত্র দিক তুলে ধরেছেন। এভাবেই তিনি মিশে যান জীবনের সঙ্গে বিচিত্র গল্প ও ঘটনার পাকচক্রেÑ যেন জীবনের সহজ কোনো পাঠ নিমেষেই তুলে ধরছেন আমাদের সামনে।
মনে পড়ে প্রথম হুমায়ূন পাঠের অভিজ্ঞতা। আধা সামরিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্যাডেট কলেজের অজস্র নিয়মের ভিড়েও নানান কসরত করে হুমায়ূন পাঠ ছিল অনিবার্য। অভিভাবকহীন চার দেয়ালের বন্দি ওই সাদা-কালো কঠোর জীবনে তিনি যে কল্পনার রঙ মেলে দিয়েছিলেন তা আজও প্রজ্বলল। তাই  মন খারাপের রাত কিংবা একঘেয়ে সময়ের অপূর্ব সঙ্গী তিনি। এভাবেই হুমায়ূন আহমেদ প্রাসঙ্গিক হয়ে আছে হাজারো তরুণ-তরুণীর মধ্যে। কোনো লেখকের সার্থকতা হয়তো মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে এই মিলিয়ে যাওয়াতেই।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh