প্যারিসে বসছে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১২ নভেম্বর ২০১৫
মাজহারুল ইসলাম

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে চারদিকে নদী বেষ্টিত ইউনিয়ন পদ্মপুকুর। ‘আইলা’য় বিধ্বস্ত এ ইউনিয়নের বাসিন্দা রেশমা বেগমের (২৫) জীবনেও বয়ে গেছে আইলা। তুফানের পর তার স্বামীকে এখনো বছরে ৬ থেকে ৮ মাস শহর কিংবা দূরে কোনো ইটের ভাটায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে হয়। এ সময় রেশমা ৪ সন্তান নিয়ে একাই সংসার সামলান। তাদের ঘরটিতে এখন এনজিও-র বদৌলতে করোগেটেড টিন। পেয়েছেন আরেক এনজিও থেকে সচেতনতামূলক অনেক উপদেশ। তারা বাড়ির আঙিনায় সবজি চাষের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কিন্তু পাশের পুকুরের পানি লবণাক্ত। এবারের বর্ষায় লবণাক্ততা কিছুটা কমেছে। তাই আশা নিয়ে ওই পানিই গাছে দিয়ে যাচ্ছেন রেশমা। অনেক দূর থেকে তাকে খাওয়ার পানি আনতে হয়। এতে সময় চলে যায় অনেক।
রেশমা বেগমের মতো অসংখ্য পরিবারের বিপর্যয় রোধের আশা নিয়ে ৩০ নভেম্বর থেকে আগামী ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্যারিসে শুরু হতে যাচ্ছে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন বা জাতিসঙ্ঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের ২১তম সম্মেলন যা কপ২১/সিএমপি১১ নামে পরিচিত হচ্ছে। এবারের সম্মেলনের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো বাসযোগ্য একটি বিশ্ব গড়ে তুলতে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি প্রাকশিল্প বিপ্লবের পর্যায়ে অর্থাৎ ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে কমিয়ে আনা এবং এ জন্য সব দেশের একটি ঐকমত্যে পৌঁছা। জাতিসঙ্ঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্যানেলের বিজ্ঞানীদের মতে, বিশ্বের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপর বাড়তে থাকলে মাত্রা অতিরিক্ত পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে যা বস্তুত সব প্রাণীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাই বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, বিশ্বে কার্বন নিঃসরণ এ শতাব্দীর শেষে শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে।
জাতিসঙ্ঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের সৃষ্টি হয় ১৯৯২ সালের রিও ডি জেনেরিও-র ধরিত্রী সম্মেলনের মাধ্যমে। এ কারণেই কিয়োটো প্রটোকলের সৃষ্টি। তা ২০০৫ সাল থেকে কার্যকর হয়। এ প্রটোকলের মাধ্যমে শিল্প উন্নত দেশগুলোর গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণের একটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এটি পরবর্তীকালে ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত কার্যকর থাকে। এরপর ২০০৭ সালে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে বালি অ্যাকশন প্ল্যান ঘোষণা করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল ২০১২ সালের কিয়োটো প্রটোকল-পরবর্তী লক্ষ্য নির্ধারণ যার মাধ্যমে ২০০৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে একটি অবস্থানে পৌঁছানো যায়। যদিও কোপেনহেগেন সম্মেলনে (কপ১৫) কোনো চুক্তিতে উপনীত হতে পারেনি তবুও সবাই এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সক্ষম হন, বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামিয়ে আনতে হবে এবং ২০২০ সালের মধ্যে উন্নত বিশ্ব স্বল্প উন্নত বিশ্বকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত মোকাবেলায় প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলারের সংস্থান করতে হবে। ২০১০ সালে মেক্সিকোর কানকুন সম্মেলনে গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের জন্ম হয়। ২০১১ সালের ডারবান সম্মেলনে উন্নত ও স্বল্প উন্নত বিশ্বÑ সবাই একমত হয়, ২০১৫ সালে একটি জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আইনগত বাধ্যবাধকতাসহ প্রটোকল স্বাক্ষরিত হবে যা ২০২০ সাল থেকে বাস্তবায়ন শুরু হবে। ২০১২ সালের দোহা কনফারেন্সের মাধ্যমে ২০১৩-২০ সাল নাগাদ একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিশ্রুতি গৃহীত হয়। ২০১৩ সালে পোল্যান্ড ও ২০১৪ সালের পেরু কনফারেন্স মূলত ২০১৫ সালের আসন্ন প্যারিস কনফারেন্সের প্রস্তুতি বলা যেতে পারে। এখানে সব দেশকে প্যারিস কনফারেন্সে নিজ নিজ দেশের গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ বন্ধে কী করছে বা করবে এ বিষয়ে বক্তব্য দাখিল করতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে সেটি দাখিল করেছে।
জাতিসঙ্ঘের এনভারনমেন্ট প্রোগ্রামের এক হিসাব মতে, বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলায় এখন কমপক্ষে ১৫০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। কিন্তু উন্নত বিশ্ব ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩০ বিলিয়ন ডলার প্রতিশ্রুতির বিপরীতে মাত্র ২.৬ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে। তা প্রতিশ্রুতির মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশ।
জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী উন্নত বিশ্ব এবং এর সবচেয়ে নেতিবাচক শিকার স্বল্প উন্নত দেশগুলোর কোটি কোটি জনগণ। বাংলাদেশ এলডিসি-র সদস্য হিসেবে এক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে আসন্ন সম্মেলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।