
অবশেষে মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত শাসন অবসানের পথে। দীর্ঘদিন পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চির দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। দীর্ঘ ২৫ বছর পর নির্বাচন অনুষ্ঠানের নেপথ্যে কিছু কারণ কাজ করছিল। সামরিক কর্মকর্তারা বুঝতে পেরেছিল সু চি-কে বাদ দিয়ে মিয়ানমারের অগ্রগতি সম্ভব নয়। তাই চার-পাঁচ বছর ধরেই আলোচনা চলছিল। এদিকে মিয়ানমারে ১৫টি বিভিন্ন ভাষাভাষী বিদ্রোহী গোষ্ঠী রয়েছে। তাদের মধ্যে সাতটির সঙ্গেও নির্বাচনের আগে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছে। ক্ষমতাসীন শাসক শ্রেণী এখন বুঝতে পেরেছে গণতান্ত্রয়নের পথ সুগম না হলে মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি সুষ্ঠু হবে না। এসব কারণের সম্মিলিত ফল হলো এই নির্বাচন।
স্বাধীনতার ঠিক পরই ১৯৪৮ সালে মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যসহ অং সান হত্যাকা-ের পর থেকে মিয়ানমার (বার্মা) সামরিক বাহিনীর দ্বারাই শাসিত হয়ে এসেছে। পরে সামরিক জান্তা নির্বাচনের ব্যবস্থা করেও ওই নির্বাচনে বিজয়ী অং সানের কন্যা অং সান সু চি-র দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমক্রেসি (এনএলডি)-কে ক্ষমতায় যেতে দেয়নি। তারা নির্বাচন বাতিল করে সু চি-কে গৃহবন্দি করে ও তার দলটিকে বেআইনি ঘোষণা করে। অনেক বছর ওই অবস্থায় থাকার পর সামরিক বাহিনীর মধ্যে কিছু রদবদল হওয়ায় তাকে তারা মুক্তি দিয়ে রাজনৈতিক কাজের অনুমতি দেয়। বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা সামরিক সরকার নির্বাচনের আয়োজন করেছে। এই নির্বাচনে সু চির দল ক্ষমতায় যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
গত রোববার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে জান্তা সমর্থিত ক্ষমতাসীন দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি)। বিপুলভাবে বিজয়ী অং সান সু চির দল এনএলডি সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। সু চি জয়ী হলেও ক্ষমতার সমীকরণটি নির্ভর করছে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার কী ধরনের সমঝোতা হয় এর ওপর। জানুয়ারিতে নতুন পার্লামেন্ট প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ পর্যন্ত বর্তমান প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন ও সেনা নিয়ন্ত্রিত ইউএসডিপি-ই ক্ষমতায় থাকছে। মিয়ানমারে গণতন্ত্রায়ণের পথে যে তিনটি চ্যালেঞ্জ ছিল তার মধ্যে দুটিতে দেশটি জয়ী হয়েছে। এক. নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। দুই. সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকারও ফল মেনে নিয়েছে।
সংবিধান অনুযায়ী মিয়ানমারের পার্লামেন্টে ২৫ শতাংশ কোটা সামরিক বাহিনীর জন্য সংরক্ষিত রয়েছে। এই আইনগত বাধ্যবাধকতা দেশটির গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে লক্ষচ্যুত করতে বা স্থবির করার ক্ষেত্রে বিশেষ নেতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পার্লামেন্টে ২৫ শতাংশ কোটা সামরিক বাহিনীর জন্য সংরক্ষণ থাকার বিষয়টি গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি ও চর্চার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যা অনেক পুরনো হলেও আমরা দেখেছি, এবারের নির্বাচনে রোহিঙ্গারা ভূমিকা রাখার সুযোগ পায়নি। কারণ দেশটির সরকার তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। এ সমস্যার কারণে দেশটির গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠায় যে অসম্পূর্ণতা দেখা দেবে তা প্রতিকারের উপায় কী? এছাড়া এবারের নির্বাচনে সামগ্রিকভাবে মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। এর প্রতিফলন দেখা যায় প্রার্থী নির্বাচনে অর্থাৎ বড় দুই দলের কোনোটিরও কোনো মুসলিম প্রার্থী নেই। এই সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতা একটি গণতান্ত্রিক দেশে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেবে।
এ বছরের গোড়ার দিকে মিয়ানমারের বর্তমান সামরিক সরকার ৭ লাখ সাদা কার্ডধারীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করেছে যাদের মধ্যে প্রায় সবাই রোহিঙ্গা মুসলমান। সু চি এর কোনো বিরোধিতা তো করেননি, উপরন্তু ওই পদক্ষেপের সমর্থক! চরমপন্থী বৌদ্ধ সাম্প্রদায়ের ভোট পাওয়ার জন্য নিজের দলটি রোহিঙ্গা মুসলমানমুক্ত করছেন। ইউএসডিপি যেভাবে এ নির্বাচনে কোনো মুসলমান প্রার্থী রাখেনি ঠিক সেভাবেই সু চি-ও এর সঙ্গে তাল রেখে নিজের এনএলডি পার্টিকে একই ব্যবস্থা করেছেন।
নির্বাচনী ফলাফলে সু চি জয়লাভ করলেও স্বামী ও সন্তান বিদেশি নাগরিক হওয়ায় প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। ফলে তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে সংবিধান সংশোধনের দাবি তুলতে পারে। এক্ষেত্রে সেনা সমর্থিত ক্ষমতাসীন ইউএসডিপি-র প্রতিবন্ধকতা তৈরির আশঙ্কা একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে নতুন সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, রোহিঙ্গা সমস্যার যেন স্থায়ী সমাধান হয়।