অর্থনীতি

বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফের ওপর নির্ভরতা কমবে উন্নয়নশীল দেশের

প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১২ নভেম্বর ২০১৫

নাজীব নিয়াজ

‘বিশ্ব অর্থনীতির ভরকেন্দ্র বা কেন্দ্রবিন্দু যুক্তরাষ্ট্র’- আজ থেকে এক দশক আগেও এ কথাটির সঙ্গে দ্বিমত করার মতো লোক খুব বেশি ছিল না। তবে দিন বদলেছে। চলতি শতকের শুরুতে একাধিক যুদ্ধের বিশাল খরচ, আর্থিক মন্দা, বেকারত্বের হার বেড়ে যাওয়া, রফতানি কমে যাওয়া ইত্যাদি কারণে আমেরিকা পিছিয়েছে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী রফতানি বৃদ্ধি, নিজস্ব বাজারে ভোগের পরিমাণ বৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি আরো কয়েকটি দেশকে নিয়ে এসেছে দৃশ্যপটে। তাই বিশ্ব অর্থনীতির বিশাল মাঠে আমেরিকা একমাত্র শক্তিশালী খেলোয়াড় আর নয়। কিন্তু এতো দিন মাঠে ক্ষমতাধরের ভূমিকায় থাকা বিশ্ব ব্যাংকের বিরুদ্ধে রয়েছে মার্কিনিদের পক্ষে স্পষ্ট পক্ষপাতের অভিযোগ। আরেক ক্ষমতাধর আইএমএফ ঝাণ্ডা উড়িয়েছে ইউরোপিয়ানদের হয়ে। এমনই এক পরিস্থিতিতে ২০১৩ সালে এসেছে ব্রিকস ব্যাংকের ঘোষণা। এর অফিশিয়াল নাম নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। গত মাসে রাশিয়া জানিয়েছে, পরবর্তী বছর ঋণদানের জন্য প্রকল্প বাছাইয়ের কাজ শুরু করেছে তারা।
কীভাবে ব্রিকস ব্যাংক গঠিত হলো?
কেন ব্রিকস ব্যাংক গঠিত হলো- এ প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আমাদের ২০০১ সালে ফিরে যেতে হবে। চীন, ভারত, রাশিয়া ও ব্রাজিলের নাম আলাদাভাবে উল্লেখ করে মার্কিন বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকস-এর সম্পদ ব্যবস্থাপক জিম ও. নিল বলেন, উদীয়মান বড় অর্থনীতি হিসেবে সামনের দিনগুলোয় বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে এ দেশগুলো। এই চার দেশকে তিনি সংক্ষেপে ব্রিক (BRIC) হিসেবে উল্লেখ করেন। পরে তার কথার গুরুত্ব বুঝতে পেরেই হয়তো এসব দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ২০০৬ সালে এক বৈঠকে মিলিত হন। ওই শুরু। ২০০৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে পথচলা শুরু করে ব্রিক দেশগুলো। ২০১০ সালে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় দক্ষিণ আফ্রিকা। এই পাঁচ দেশের নামের অদ্যাক্ষর মিলিয়ে তাদের ডাকা হতে থাকে ব্রিকস (ইজওঈঝ) নামে। তবে দেশগুলোর কার্যক্রম এই পর্যন্ত বার্ষিক সম্মেলন ও দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতির মধ্যেই মোটামুটি সীমাবদ্ধ ছিল।
২০১৩ সালে সর্বপ্রথম দেশগুলো একটি বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ঘোষণা দেয়। এমন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিল সবাই। পশ্চিমাপন্থী অনেক বিশ্লেষকই জানিয়েছিল, এ ব্যাংক হবে বিশ্ব ব্যাংক এবং আইএমএফ-এর জন্য সরাসরি চ্যালেঞ্জ।
কেন ব্রিকস ব্যাংক গঠিত হলো?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশগুলোয় অবকাঠামো উন্নয়নে অর্থ সহায়তা দিয়ে আসছে বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ। এই দুটি সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগÑ সহায়তার নামে তারা আসলে বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থার স্বার্থ উদ্ধার করে আসছে। ঋণের নামে চাপানো হচ্ছে কঠিন শর্ত। তারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ)-এর নেতৃস্থানীয় দেশগুলোর রাজনৈতিক স্বার্থও হাসিল করে। তাদের শর্ত মানতে ঋণের টাকা প্রায় পুরোটাই উজাড় হয়ে যায়। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে আর কোনো বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় এ দুই সংস্থার ওপরই নির্ভর করতে হয়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে।
ব্রিকস ব্যাংকের কার্যপরিধিও অবকাঠামো উন্নয়নে অর্থসহায়তা দেবে। এতেই আশার আলো দেখছে ঋণ গ্রহীতা বিভিন্ন দেশ। এমনকি ব্রিকস ব্যাংক ঋণ পেতে দরকষাকষির সুযোগ করে দেবে। যদি সহজ শর্তে ঋণ মিলে তাহলে বিশ্ব ব্যাংক এবং আইএমএফের কঠিন শর্তের দ্বারস্থ হতে চাইবে না কেউই।
শুধু ঋণের বিষয়েই নয়, বিশ্ব ব্যাংক এবং আইএমএফের বিষয়ে সব সিদ্ধান্তই দেয় ইউরোপ-আমেরিকার মতো দেশগুলো। ভোটাভুটির ব্যবস্থা থাকলেও সম্পদ বা জনসংখ্যার হিসেবে ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোই বেশি সুযোগ পেয়ে থাকে। অথচ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪২ শতাংশই রয়েছে ওই পাঁচটি ব্রিকসভুক্ত দেশে। বিশ্বের মোট জিডিপি-র ২০ শতাংশ আসে ওই দেশগুলো থেকে। তাই ব্রিকসের দেশগুলোও নিজেদের স্বার্থেই ব্যাংক খোলার সিদ্ধান্তে এসেছে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন, ব্রিকস ব্যাংক যেসব মুদ্রায় ঋণ অনুমোদন দেবে তা নিজস্ব দেশের- ডলারে নয়। বিষয়টি স্পষ্ট, তারা ডলারের বিকল্প মুদ্রা তৈরি করতে চাচ্ছেন। ডলারে আন্তর্জাতিক লেনদেন মানেই আমেরিকার ব্যাংকিং সিস্টেম ও সরকারের আওতায় থাকা। তাই এটি থেকে মুক্তি পেতেই ওই প্রচেষ্টা।
শক্ত ব্রিকসের প্রত্যাশা
২০১২ সালে যখন এ ব্যাংক গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তখন বিশ্ব অর্থনীতি মোটামুটি এক দীর্ঘ মন্দা থেকে বেরিয়ে আসছে। বৈশ্বিক জিডিপি, বাণিজ্যের পরিমাণ, বিনিয়োগ ও নতুন চাকরি সৃষ্টির মতো আর্থিক সূচকগুলোর গ্রাফ উঠতে শুরু করেছে অর্থাৎ নতুন একটি বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরুর জন্য সময়টা অনুকূলই ছিল। তবে গেল ৩ বছরে দৃশ্যপট পাল্টেছে অনেক। ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোকে পার করতে হয়েছে কঠিন সময়।
রাশিয়ার কথাই ধরা যাক। ইউক্রেন-এ রাশিয়ার হস্তক্ষেপে বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। আর্থিক নিষেধাজ্ঞার মুখেও পড়তে হয় তাদের। এতে পশ্চিমা অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগকারী হাত গুটিয়ে নিয়েছেন সেখান থেকে। এরই প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়াও পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ইউরোপ-আমেরিকায় গম, দুগ্ধজাত পণ্য রফতানি বন্ধ করে দেয়। তেলের পড়তি দামও দেশটির অর্থনীতিতে আঘাত করেছে চরমভাবে।
চীন এরই মধ্যে বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। অনেক দেশেরই আমদানি-রফতানি চীনের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। তাই এ অর্থনীতির গতি দুর্বল হয়ে আসার প্রভাব পড়েছে বৈশ্বিক বাণিজ্যে। দেশটির শেয়ারবাজারের ধস সূচক নামিয়ে দিয়েছে অন্য পুঁজিবাজারেও। রফতানি ঠিক রাখতে এরই মধ্যে টানা কয়েকবার নিজস্ব মুদ্রা ইউয়ান-এর দাম কমিয়েছেন তারা।
আর্থিক দুর্দশার ধাক্কা সরাসরি লাগেনি কেবল ভারতের গায়ে। এ জন্য বাহবা পেতেই পারেন দেশটির আর্থিক খাতের নীতি-নির্ধারকরা। তবে খুব একটা স্বস্তিকর অবস্থায় নেই তারাও। এ সময়ে দুর্নীতির অভিযোগ এবং লাল ফিতার দৌরাত্ম্যের কারণে বার বারই আন্তর্জাতিক খবরের শিরোনাম হয়েছে ভারত। মোদি সরকারের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ ক্যাম্পেইন প্রশংসা পেলেও বিনিয়োগের পালে তেমন জোর বাতাস লাগাতে পারেনি।
ব্রাজিলের অবস্থাও তথৈবচ। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা আভাস দিয়েছিলেন, দেশটির আর্থিক সম্ভাবনা অসীম এবং প্রবৃদ্ধিও বাড়বে ওই হারে। তাই সেখানকার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও পেয়ে এসেছে উচ্চ ক্রেডিট রেটিং। তবে হঠাৎ করেই পরিস্থিতি বদলে গেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, আর্থিকভাবে অসফল এক বিশ্ব কাপের আয়োজনÑ সব মিলিয়ে পরিস্থিতি অনুকূলে নেই তাদেরও। ফলে ব্রিকস ব্যাংকের যে ঘোষণা আশার সঞ্চার করেছিল এর কতোখানি শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হবে তা নিয়ে ভাবনার যথেষ্টই অবকাশ থেকে যাচ্ছে।
বিশ্ব ব্যাংক এবং আইএমএফের সমালোচকদের জন্য আপাতত ব্রিকস ব্যাংক শুধুই একটি বিকল্প। এটি যদি ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরিতে কাজ করে যায় তাহলে তা হবে সবার জন্যই মঙ্গলকর। তেমন শক্তিশালী ব্রিকসের প্রত্যাশা সবার। এটি না হয়ে যদি চীন, রাশিয়া বা ভারতের স্বার্থ রক্ষাতেই সংস্থাটি কাজ করে তাহলে কতোখানি সফল হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। এর উত্তর কেবল সময়ের হাতেই তোলা।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh